ঢাকাবৃহস্পতিবার , ১৯ জুন ২০২৫
  • অন্যান্য

বাংলাদেশের বাতাসের মান উন্নয়ন প্রকল্পে ২৯ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ১৯, ২০২৫ ৩:৫৪ অপরাহ্ণ । ৬৯ জন

বাংলাদেশের বাতাস আজ এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন এমন এক পরিবেশে, যেখানে অদৃশ্য অথচ মারাত্মক বায়ুদূষণ তাদের জীবনের ওপর অজানা এবং অদৃশ্যভাবে খরচ করে যাচ্ছে সময় ও স্বাস্থ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি কিউবিক মিটারে সূক্ষ্ম ধূলিকণার (PM2.5) গ্রহণযোগ্য মাত্রা যেখানে ৫ মাইক্রোগ্রাম, সেখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এই মাত্রা কখনো কখনো গড়ে তার ১৮ গুণেরও বেশি থাকে। এটি শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি সতর্ক সংকেত, যা বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং পরিবেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতির পূর্বাভাস দেয়।

২০১৯ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে ১ লাখ ৫৯ হাজারের বেশি মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে এবং মানুষ ভুগেছে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন দিনব্যাপী অসুস্থতায়। এই বিপুল স্বাস্থ্য ব্যয়ের অর্থনৈতিক পরিমাণ দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ৮.৩ শতাংশের সমান। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সহায়তায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে—নির্মল বায়ু প্রকল্প (Bangladesh Clean Air Project)। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মাধ্যমে একটি ব্যাপক ও সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ু দূষণের মূল উৎসগুলো শনাক্ত করে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

প্রকল্পের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো পরিবেশ অধিদপ্তরের আওতায় বায়ু গুণমান পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করা। বর্তমানে বাংলাদেশে যতগুলো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোর সংখ্যা ও কার্যকারিতা বায়ু দূষণ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহের জন্য অপর্যাপ্ত। ফলে, দূষণের উৎস শনাক্ত করা এবং যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। নির্মল বায়ু প্রকল্পের অধীনে সারা দেশে নতুন ও উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন পর্যবেক্ষণ স্টেশন স্থাপন করা হবে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরবিচারে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে চালু করা হবে ‘নিরবিচার নির্গমন পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি’ বা Continuous Emissions Monitoring Program (CEMP)। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিশেষ করে শিল্প এলাকা ও বড় কারখানাগুলোর নির্গমনকে নিয়মিতভাবে রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। ফলে নির্ধারিত নির্গমন সীমা অতিক্রম করা হয়েছে কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যাবে এবং পরিবেশ আইন প্রয়োগে সহজতর হবে। এই ধরণের প্রযুক্তিগত ও তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় অতীতের বহু পরিবেশবিরোধী কার্যক্রম কোনো প্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে চালু ছিল। CEMP বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই শূন্যস্থান পূরণ করে সুনির্দিষ্টভাবে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের বায়ু দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় নির্মাণ কাজ, যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, ইটভাটা, এবং শিল্প কলকারখানার অপরিকল্পিত নির্গমনকে। ঢাকায় প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি ইটভাটা রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই এখনও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হয়নি। এর ফলে প্রতি বছর শীতকালে বায়ু দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। নির্মল বায়ু প্রকল্পে এই খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে ধাপে ধাপে দূষণ কমানোর চেষ্টা করা হবে।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত এই প্রকল্পটি শুধু মাত্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বায়ু মান ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সিটি কর্পোরেশনসমূহ, এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কার্যকর পরিবেশ রক্ষাকারী কাঠামো গড়ে তোলা হবে।

এ প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের নাগরিকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র প্রযুক্তি বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়, যদি না সাধারণ জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে ওঠে। যারা প্রতিদিন রাস্তার পাশে খোলা স্থানে বর্জ্য পোড়ান, যারা নিয়মিত গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা ছাড়াই চলাচল করেন কিংবা যারা অবহেলায় নির্মাণসামগ্রী খোলা জায়গায় রাখেন, তারা সকলেই এই দূষণের জন্য দায়ী। তাই প্রকল্পের অংশ হিসেবে জনসচেতনতা বাড়ানোর বিভিন্ন প্রচারণা এবং শিক্ষা কার্যক্রমও পরিচালিত হবে।

পরিবেশগত ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে, এই প্রকল্প বিশেষ গুরুত্ব দেবে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর বায়ু দূষণের প্রভাব বিশ্লেষণে। কারণ, বস্তি এলাকা, শিল্পাঞ্চলের আশেপাশে বসবাসকারী মানুষ, এবং রাস্তার পাশে বাস করা নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার হন, অথচ তাদের এই দূষণের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। প্রকল্পের মাধ্যমে এই শ্রেণির মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব নিরীক্ষা ও প্রশমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তা দেশের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির একটি বড় প্রতিবন্ধক। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বায়ু দূষণজনিত স্বাস্থ্য ব্যয় ছিল জিডিপির ৮.৩ শতাংশের সমান। এই পরিমাণ অর্থ যদি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা যেত, তবে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার নাটকীয় উন্নয়ন সম্ভব হতো। তাই নির্মল বায়ু প্রকল্প একটি প্রতিরক্ষামূলক খরচ নয় বরং একটি ভবিষ্যত বিনিয়োগ।

এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ এবং বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তোলার ভিত্তি। আমরা যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তবে পরিবেশের এই ক্ষয় আমাদের শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত বা আর্থিক ক্ষতির দিকে ঠেলে দেবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনমান এবং সুযোগের ওপরও বড় ধরনের ছাপ ফেলবে। নির্মল বায়ু প্রকল্প তাই কেবল একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়, বরং এটি এক প্রকার জাতিগত অঙ্গীকার—নিরাপদ, নির্মল এবং টেকসই ভবিষ্যতের পথ রচনার প্রতিশ্রুতি।

সবশেষে বলা যায়, নির্মল বায়ু প্রকল্প হচ্ছে একটি প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ যা আমাদের দেশের বায়ু দূষণজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। একে সফল করতে প্রয়োজন জাতীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা, নাগরিক সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। যদি এই চারটি স্তম্ভকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের আকাশ একদিন নির্মল হবে—স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো।