বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্রে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। শুধু সামরিক শক্তি নয়—আজকের দুনিয়ায় একটি রাষ্ট্রকে ক্ষমতাধর করে তোলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কৌশলগত জোট, কূটনৈতিক দক্ষতা, প্রযুক্তি উৎকর্ষ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব। এমন বাস্তবতায় তৈরি হয়েছে ২০২৫ সালের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ৫০টি দেশের তালিকা, যেখানে বাংলাদেশ রয়েছে ৪৭তম অবস্থানে—যা দেশের জন্য এক যুগান্তকারী স্বীকৃতি।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের নেতৃত্বে রয়েছে। প্রযুক্তি, সামরিক, কূটনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাব সবদিক দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অটুট। চীন ধীরে ধীরে বিশ্বব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে, রাশিয়া রয়েছে পুরাতন সামরিক পরাশক্তি হিসেবেই, আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় দেশগুলো—যেমন যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স—কূটনৈতিক নীতিতে ও মানবিক সংকট মোকাবেলায় তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

আসুন এবার একে একে ২০২৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই ৫০টি দেশের বিশ্লেষণে যাওয়া যাক, যারা শুধু নিজেদের জনগণের ভাগ্যই নয় বরং গোটা বিশ্বের নীতিনির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো পরাশক্তির প্রতীক। সামরিক খাতে বিশাল বাজেট, ন্যাটোর নেতৃত্ব, ডলারভিত্তিক বিশ্ব অর্থনীতি, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বব্যাপী দখল এবং হলিউড-সহ সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার প্রতিটি কোণায় প্রভাব ফেলছে। তাদের আন্তর্জাতিক জোট, প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং জাতিসংঘে প্রভাব তাদের অবস্থানকে আরো দৃঢ় করেছে।
চীন এখন আর কেবল ‘বিকাশমান অর্থনীতি’ নয়, বরং এক পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতাবান রাষ্ট্র। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি চীনকে একটি শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক উপস্থিতি ও আফ্রিকায় বিনিয়োগ তাদের প্রভাব আরও বাড়িয়েছে।
রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও, সামরিক শক্তি এবং জ্বালানি সম্পদের দখলে তাদের গুরুত্ব কমেনি। ভূ-রাজনীতিতে এখনো তারা গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়—বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, সিরিয়া এবং আফ্রিকায় তাদের প্রভাব চোখে পড়ার মতো।
যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিটের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কিছুটা চাপে পড়লেও, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, ন্যাটোর সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত শক্তি হিসেবে তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে তাদের কূটনৈতিক মিশন এবং কমনওয়েলথের সদস্যদের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক তাদের ক্ষমতার ভিত্তি রক্ষা করে চলেছে।
জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল চালিকাশক্তি। প্রযুক্তি, গাড়ি শিল্প, সবুজ জ্বালানি খাত এবং ইউরোপের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জার্মানির অবদান অস্বীকার করা যায় না। যদিও তারা সামরিকভাবে অনেকটা সংযত, তবুও অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কূটনীতিতে তারা একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি।
দক্ষিণ কোরিয়া প্রযুক্তি এবং সামরিক প্রতিরক্ষা খাতে নিজেদের শক্তিশালী করেছে। স্যামসাং, এলজি-এর মতো বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি ব্র্যান্ড, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং আমেরিকার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি দক্ষিণ কোরিয়াকে পূর্ব এশিয়ায় একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
ফ্রান্স, বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র যারা আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তারা জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো, G7-এ সক্রিয় ভূমিকা রাখে। পরমাণু শক্তি, অস্ত্র শিল্প এবং ফ্যাশন ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ফ্রান্সকে শক্তিশালী করেছে।
জাপান বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কেন্দ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সামরিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা সামরিক খাতে বাজেট বৃদ্ধি করেছে, যা তাদের প্রভাব বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার দিন দিন ক্ষমতাধর হয়ে উঠছে। তেল সম্পদ, ইসলামিক বিশ্বের নেতৃত্ব, পশ্চিমা জোটের সঙ্গে সম্পর্ক এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে তারা নিজস্ব বলয় গড়ে তুলেছে। সৌদি আরব “ভিশন ২০৩০”–এর মাধ্যমে একটি নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে।
ইসরায়েল একটি প্রযুক্তি-ভিত্তিক সামরিক পরাশক্তি। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তাদের কৌশলগত অবস্থান এবং মার্কিন সমর্থন তাদের বৈশ্বিক ক্ষমতা বাড়িয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা, আকাশ প্রতিরক্ষা, ও সামরিক উদ্ভাবনে তারা অগ্রণী।
ভারত বিশাল জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উদীয়মান প্রযুক্তি খাতের কারণে এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। যদিও নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয়তা, BRICS-এর নেতৃত্ব এবং প্রতিরক্ষা খাতে দ্রুত অগ্রগতি ভারতের ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।
ইউক্রেন, যদিও যুদ্ধবিধ্বস্ত, তবুও ২০২২ সাল থেকে তারা যে দৃঢ়তা ও আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করেছে তা নজিরবিহীন। পশ্চিমা অস্ত্র, অর্থনৈতিক সাহায্য এবং কৌশলগত সহানুভূতির কারণে তারা এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্ব পাচ্ছে।
ইরান, তেল সম্পদ ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এখনো গুরুত্বপূর্ণ। পরমাণু কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে তাদের ভূমিকা এখনো বহু রাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়।
অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা, যদিও বড় কোনো সামরিক শক্তি নয়, তবে উন্নত অর্থনীতি, কূটনৈতিক সক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক জোটে অংশগ্রহণের কারণে তারা তালিকার উপরের দিকে রয়েছে।
নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, সুইডেন—এই দেশগুলো সামরিকভাবে প্রথাগত শক্তি না হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতি এবং ন্যাটো ও জাতিসংঘে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে।
ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়া লাতিন আমেরিকার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক সুযোগ তাদের প্রভাব বাড়িয়েছে।
এশিয়ার উদীয়মান শক্তি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া তাদের জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং কৌশলগত অবস্থানের কারণে এই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।
আফ্রিকার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ও মিসর এখনো অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। ইতিহাস, সামরিক অবকাঠামো এবং আঞ্চলিক নেতৃত্ব তাদের এই অবস্থানে রেখেছে।
এমনকি তুলনামূলক ছোট দেশ কুয়েত, লুক্সেমবার্গ, ফিনল্যান্ড বা জর্ডানও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। লুক্সেমবার্গ যেমন ইউরোপীয় অর্থনীতিতে শক্তিশালী আর্থিক খাতের জন্য পরিচিত, তেমনি জর্ডান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার প্রতীক।
বাংলাদেশ এই তালিকায় ৪৭তম অবস্থানে উঠে এসেছে, যা দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিবেশে সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ, শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয়তা, ও শ্রমনির্ভর বৈদেশিক অর্থপ্রবাহ—এই সমস্ত কিছুর সম্মিলনে বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
২০২৫ সালের এই তালিকা একটি বার্তা দেয়—ক্ষমতা কেবল অস্ত্রের দাপটে আসে না। অর্থনীতি, কূটনীতি, প্রযুক্তি, জনসংখ্যা, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং নৈতিক নেতৃত্বও এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মূল উপাদান। বিশ্ব এখন বহুমাত্রিক নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে, যেখানে বড় শক্তির পাশাপাশি আঞ্চলিক বা কৌশলগত শক্তির দেশগুলোও একে অপরের সমান অংশীদার।
এই তালিকা ভবিষ্যতের জন্য একটি দিকনির্দেশনা, যাতে আমরা দেখতে পাই কোন কোন দেশ কেবল নিজস্ব স্বার্থে নয় বরং বৈশ্বিক স্বার্থেও অবদান রাখছে। আর এই দুনিয়াতেই কেউ স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকে না। পরিবর্তন হয়, নেতৃত্ব বদলায়, কিন্তু ইতিহাস মনে রাখে কে কখন কতটুকু অবদান রেখেছে বিশ্ব ব্যবস্থার নির্মাণে।
তথ্যসূত্র: U.S. News & World Report


