ঢাকাসোমবার , ৯ জুন ২০২৫

ঘূর্ণিঝড়ের পথরেখা: বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধমান হুমকি ও দক্ষিণাঞ্চলের জীবনসংগ্রাম

রঞ্জন কুমার দে
জুন ৯, ২০২৫ ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ । ১৪৪ জন

ঘূর্ণিঝড় — শব্দটির সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে উপকূলীয় বাংলাদেশের মানুষের এক নিবিড় সম্পর্ক। বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা এই তাণ্ডবলীলা কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এক একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের সূচনাও বটে। এ যেন প্রকৃতির এক চিরস্থায়ী তর্জনী, যা বারবার মনে করিয়ে দেয় দুর্বল অবকাঠামো, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দারিদ্র্যের কী ভয়াবহ মিথস্ক্রিয়া ঘটে এখানে।

২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর রাতটি যেন এখনো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ স্মৃতি হয়ে আছে। ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে উপকূলীয় অঞ্চলে। উপগ্রহ চিত্রে সিডরকে একটি পরিপূর্ণ সাইক্লোনিক আই বা কেন্দ্রবিন্দুসহ ধরা পড়ে, যার গতি ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিমি। ৩৪০০ জন মানুষ নিহত হন, লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

এর আগে ২০০৬ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘মালা’ মিয়ানমারের দিক দিয়ে বয়ে গেলেও বাংলাদেশের ওপর প্রভাব তুলনামূলক কম পড়ে। কিন্তু এর পর থেকে ঘূর্ণিঝড় যেন প্রতিবছরের নিয়মিত অতিথি হয়ে দাঁড়ায়।

২০০৮ সালে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় নার্গিস মূলত মিয়ানমারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও এর প্রভাব বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলেও আংশিক অনুভূত হয়। ২০০৯ সালে আইলা যেন সিডরের ঠিক পরবর্তী বড় আঘাত হয়ে আসে। পাথরঘাটা, শ্যামনগর, কয়রা — প্রতিটি জনপদে ভেসে যায় গ্রাম, লবণাক্ততা চিরস্থায়ী রূপ নেয়। আইলায় প্রায় ১৯০ জন মানুষ প্রাণ হারান এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। খাল-বিল লবণাক্ত হয়ে পড়ে, কৃষি ও মাছ চাষ প্রায় ধ্বংস হয়।

২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ফাইলিন ভারতের উড়িষ্যার দিকে আঘাত হানে, কিন্তু বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে, বিশেষ করে উপকূলীয় জেলাগুলোতে জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয়। একই বছর ঘূর্ণিঝড় হেলেন তুলনামূলক দুর্বল থাকলেও ক্ষয়ক্ষতির কিছু খবর আসে।

২০১৪ সালে হুদহুদ ভারতের অন্ধ্র উপকূলে আঘাত হানে। বাংলাদেশের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল না, তবে পরোক্ষ প্রভাবে আবহাওয়াগত বিপর্যয় তৈরি হয়।

২০১৫ সালে কোমেন ঘূর্ণিঝড় স্বল্প শক্তিশালী হলেও প্রবল বর্ষণ এবং বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষতি করে। ২০১৬ সালের রোয়ানু ছিল অপেক্ষাকৃত অনিয়মিত ঘূর্ণিঝড়, যা বরিশাল, চট্টগ্রামসহ অনেক জেলায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা এবং ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়। ভারদাহও সে বছর ভারতের দিক দিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।

২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় মোরা বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং পার্বত্য অঞ্চলে বড় আঘাত হানে। রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হন। এই ঝড়ে কমপক্ষে ৬ জন নিহত হন এবং বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই বছরের শেষ দিকে ঘূর্ণিঝড় ওখি ভারতে আঘাত হানলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশেও ভারী বৃষ্টিপাত হয়।

২০১৮ সালের ঘূর্ণিঝড় তিতলি ভারতে আঘাত হানে, কিন্তু এর পরোক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ুগত অস্থিরতা দেখা দেয়।

২০১৯ সাল ছিল একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের বছর। ফণী ছিল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ঝড় — ভারতের পুরী উপকূল দিয়ে ঢুকে খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে প্রবেশ করে। প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয় ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে। এরপর আসে বুলবুল, যা বাংলাদেশে সরাসরি আঘাত হানে। শতাধিক মানুষ আহত হন এবং কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হয়।

২০২০ সালের মে মাসে ঘটে আরেক ভয়াল ঘটনা — ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ঝড়। প্রায় ১০০ জন নিহত হন, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে জলাবদ্ধতা দীর্ঘমেয়াদে থেকে যায়। ওই বছর জুনে নিসর্গ নামের আরেকটি ঝড় হলেও তা বাংলাদেশে তেমন প্রভাব ফেলেনি।

২০২১ সালে ইয়াস নামের ঘূর্ণিঝড় ভারতে প্রবেশ করে, তবে এর জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী এলাকায় ভাঙন সৃষ্টি করে। বছরের শেষ দিকে জাওয়াদ নামের ঘূর্ণিঝড় আবারো পূর্বাভাস তৈরি করে, যদিও ততটা ক্ষতি হয়নি।

২০২২ সালের ঘূর্ণিঝড় আসানি ভারতের দিকে অগ্রসর হয়, তবে এর ফলশ্রুতিতে উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড় ছিল সিত্রাং। এটি রাতে আঘাত হানে, ফলে বহু মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেনি। প্রায় ৩৫ জনের মৃত্যু হয়, ১০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা — সবকিছু বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

২০২৩ সালের মে মাসে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় মোচা। এটি কক্সবাজার উপকূল এবং রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রবলভাবে আঘাত হানে। যদিও পূর্ব প্রস্তুতির ফলে বড় প্রাণহানি এড়ানো যায়, তবু ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও অবকাঠামোতে শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়। মোচা ছিল বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটি।

২০২৪ সালে যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, তার নাম ছিল ‘দানা’। এটি বাংলাদেশে সরাসরি আঘাত হানেনি, তবে এর প্রভাবে ভারী বর্ষণ, জলাবদ্ধতা এবং কৃষিজমিতে পানি জমে থেকে ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দেয়। জলবায়ু বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ এখন আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে, এবং এই প্রক্রিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

সবশেষে, ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত কোনও ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত নাম আসেনি, তবে নামের তালিকায় পরবর্তী নাম হতে পারে ‘তেজি’ বা অন্যকিছু। এই নামে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ভারত মহাসাগরীয় ঝড় নামকরণ কমিটির হাতে থাকে।

এই দুই দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বঙ্গোপসাগরের এই ঘূর্ণিঝড়পুঞ্জ উপকূলীয় মানুষের জীবনে ভয়াবহতা, অনিশ্চয়তা এবং আর্থ-সামাজিক সংকটের এক সমান্তরাল বৃত্ত তৈরি করেছে। প্রতিটি ঝড় শুধু ঘরবাড়ি ধ্বংস করেনি, ভেঙে দিয়েছে জীবনযাপনের স্বাভাবিক ধারা, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এখন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, আগাম বার্তা প্রচার এবং উপকূলীয় জনগণকে সচেতন করতে কাজ করছে। তবু এই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ জনপদে প্রতিটি মৌসুম যেন এক পরীক্ষা হয়ে আসে। শুধু বাঁধ বা আশ্রয়কেন্দ্র নয়, প্রয়োজন জলবায়ু ন্যায্যতা এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন নীতি। কারণ ঘূর্ণিঝড় এখন আর শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি এক সমষ্টিগত অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুই দশকের এই ঘূর্ণিঝড়-ইতিহাস আমাদের সামনে যেসব প্রশ্ন তুলে ধরে তা শুধু প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া নয়, বরং উন্নয়ন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অসংগতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা, এবং সবচেয়ে বড় কথা, নিপীড়িত উপকূলীয় জনগণের প্রতি কেন্দ্রীয় ও বৈশ্বিক উদাসীনতার প্রতিচ্ছবি। ঘূর্ণিঝড়োত্তর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে কার্যকর পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকলে কেবল ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কণ্ঠস্বর, তাদের জীবনসংগ্রামের বর্ণনা, দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতির গাফিলতি এবং দুর্যোগ-পরবর্তী প্রশাসনিক ব্যর্থতা—এসব তুলে ধরতে না পারলে শুধু পরিসংখ্যানেই ঝড় থেমে থাকবে, তার আর্থ-সামাজিক অভিঘাত অনুচারিতই থেকে যাবে।