বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি (EPI) জনস্বাস্থ্যে বৈশ্বিক সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে। গত দুই দশকে ৫ কোটিরও বেশি শিশুকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ৯৪ হাজার শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে। একইসঙ্গে ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার ৮১.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে—যা বাংলাদেশসহ মাত্র ছয়টি দেশ অর্জন করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত এক প্রেস কনফারেন্সে এ তথ্য তুলে ধরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—টিকায় বিনিয়োগকৃত প্রতি ১ ডলারে ২৫.৪ ডলার রিটার্ন আসে (সূত্র: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়/ইউনিসেফ, ২০২৩)। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে পোলিও নির্মূল, মাতৃ ও নবজাতক ধনুষ্টঙ্কার (MNT) নির্মূল এবং হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পেয়েছে। কিশোরী মেয়েদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ এইচপিভি (HPV) টিকা কভারেজ অর্জিত হয়েছে, যা সার্ভিকাল ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া ইউনিসেফের সহায়তায় দেশে চালু হয়েছে ভ্যাক্সইপিআই (VaxEPI), ই-ট্র্যাকার, জিআইএস-ভিত্তিক অনলাইন মাইক্রোপ্ল্যানিং ও ই-ভিএলএমআইএস। ইপিআই সদর দপ্তর ও দেশের ৬১ জেলায় ইতোমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে ১২০টি উদ্ভাবনী ওয়াক-ইন কুলার রুম। আগামী ১২ অক্টোবর ২০২৫ সাল থেকে সরকার টাইফয়েড প্রতিরোধে টিসিভি ক্যাম্পেইন শুরু করতে যাচ্ছে, যেখানে প্রায় ৫ কোটি শিশু টিকার আওতায় আসবে।
তবে সাফল্যের পাশাপাশি কিছু বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইপিআই প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ৪০ শতাংশ পদ এখনও শূন্য, যার মধ্যে সদর দপ্তরে শূন্যপদ ৪৩ শতাংশ। ৪৫ জেলায় টিকাদান কর্মী নিয়োগ হয়নি, জেলা পর্যায়ের কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ানের ৫৩ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। বাজেট বরাদ্দে দেরি, ৫ম এইচপিএনএসপি বাতিল এবং নতুন উন্নয়ন প্রকল্প (ডিপিপি) অনুমোদন না হওয়ায় টিকা ক্রয় ও পরিবহনে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এমনকি সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্থ ছাড় না হলে ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে টিকার মজুদ সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়া দুর্গম এলাকায় পর্যাপ্ত টিকাদান কেন্দ্র ও কর্মীর অভাব, শহরাঞ্চলে আন্তব্যক্তিক যোগাযোগ (IPC) ঘাটতি এবং জনসংখ্যা নির্ধারণে অসামঞ্জস্যতা টিকাদান প্রক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে—শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ সম্পন্ন করা, সিটি কর্পোরেশনে নিজস্ব টিকাদান কর্মী নিয়োগ, সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে বাজেট বরাদ্দ ও অর্থ ছাড় নিশ্চিত করা, ভ্যাকসিন সরবরাহ ও কোল্ড চেইন রক্ষণাবেক্ষণে সরকারি বাজেট বরাদ্দ করা, দুর্গম এলাকায় বিশেষ উদ্যোগ ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো, ইউনিসেফ-সমর্থিত ডিজিটাল উদ্ভাবনের সম্প্রসারণ ও স্থায়ীকরণে বাজেট বরাদ্দ করা এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ, মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি বিশ্বকে দেখাচ্ছে যে সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা, যথাযথ অর্থায়ন ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুর জীবন রক্ষা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন করা সম্ভব।


