ঢাকাসোমবার , ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
  • অন্যান্য

বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের অবৈধ বাণিজ্য, প্রোপাগান্ডা ও প্রতিরোধে করণীয়

ইব্রাহীম খলিল
ডিসেম্বর ৮, ২০২৫ ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ । ৫৯ জন

তামাকের অবৈধ বাণিজ্য কি?

তামাকের অবৈধ বাণিজ্য (Illicit Tobacco Trade) কে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক দেশের বাইরে হতে সিগারেট চোরাচালান এবং দ্বিতীয়তটি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে কর ফাঁকি দিয়ে সিগারেট বা তামাক বিক্রয়। আমাদের দেশে তামাক চোরাচালান বলতে দুটি বিষয়কে এক করে ফেলা হয়। আমাদের দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সিগারেট বিক্রয়ের পরিমাণ অনেক বেশি, যা মুলত দেশে তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো করে থাকে।

বাংলাদেশে দেশের বাইরে হতে তামাক চোরাচালানের পরিমান কত?

তামাকজাত দ্রব্য ও তামাকের বাণিজ্য আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বিশাল হুমকিস্বরুপ সে ব্যাপারে অনেকেই কমবেশি অবগত। তবে তামাকজাত দ্রব্যের অবৈধ বাণিজ্য এই হুমকির মাত্রাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে সেটাও অযৌক্তিক নয়। কারণ অবৈধ বাণিজ্য সিগারেটকে আরো সাশ্রয়ী করে ফেলে, তরুণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের আরও বেশি তামাকসেবনে উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ তামাক বাণিজ্য তামাক কর ব্যবস্থার কার্যকারিতা হ্রাস করে, কম দামের সিগারেটের প্রাপ্যতা বাড়ায়, যা তামাকের ব্যবহার বাড়িয়ে মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় এবং সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির সম্মুখীন করে।১   কিন্তু বাংলাদেশে তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। কারণ প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি হয়। ফলে সেই সব দেশ থেকে অবৈধ ও চোরাচালানের মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্য দেশে নিয়ে এসে ব্যবসা করার যক্তি ভিত্তিহীন।

বাংলাদেশের তামাক কোম্পানিগুলো বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর ও মূল্য বাড়ালে দেশে তামাকজাত দ্রব্যের অবৈধ বাণিজ্য বেড়ে যাবে। কারণ ক্রেতারা ধূমপান কমানো বা ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে তখন নাকি অবৈধ তামাকজাত দ্রব্যের দিকে ঝুঁকবে। কিন্ত প্রকৃতপক্ষে এই দাবির কোন ভিত্তি নেই। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে যেসব দেশে সিগারেটের মূল্য এবং এর উপর আরোপিত করের হার বেশি সেসব দেশের চেয়ে যেখানে মূল্য ও কর কম সেইসব দেশেই বরঞ্চ অবৈধ বাণিজ্যের ব্যপ্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশে তামাকের অবৈধ বাণিজ্য বৈশ্বিক পরিসংখ্যান তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণে কম। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবৈধ ব্যাবসার হার শতকরা ২ ভাগেরও কম, যেখানে বৈশ্বিক অবৈধ বাণিজ্যের হার আনুমানিক ১০%-১২%। এই গবেষণায় আরও উঠে আসে যে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ এবং তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের ক্ষেত্রে ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহারের কারণে দেশে অবৈধ বণিজ্যের পরিমাণ পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে যথেষ্ট কমে এসেছে।

অপরদিকে, বাংলাদেশের বাজারে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্যের ব্যাপ্তি এবং এর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের উদ্দেশ্যে গবেষণা সংস্থা আর্ক ফাউন্ডেশান সম্প্রতি একটি ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই সমীক্ষায় দেশের ৮টি বিভাগের মোট ৪০টি গ্রামীণ ও ৪০টি শহুরে এলাকা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় প্রায় ২৫ হাজার (২৪৩৬৩) সিগারেটের প্যাকেট সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে বিদেশী অবৈধ পণ্য এবং সেইসাথে স্থানীয় পণ্যের ক্ষেত্রে অবৈধ পন্থার প্রচলন বিবেচনা করে বাংলাদেশের বাজারে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্যের হার মাত্র ৫.৪%। তাছাড়া শহুরে ও গ্রামীণ এলাকায় অবৈধ বাণিজ্যের মাত্রার মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পাওয়া যায়নি। তবে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সমীক্ষায় সংগৃহীত সিগারেটের প্যাকেটগলোর প্রধান অবৈধ বৈশিষ্ট্যটি ট্যাক্স স্ট্যাম্পের সাথে সম্পর্কিত, যদিও এর মাত্রাও বাস্তবিক ক্ষেত্রে খুব কম।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয়পর্যায়েরই গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে তামাকের বিশেষ করে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্যের মাত্রা খুব একটা উদ্বেগজনক নয়। যদিও বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মনিটরিং এর অভাব এবং অনিবন্ধিত ও নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিচালিত কারখানার কারণে এই স্তরের তামাক পণ্যের ক্ষেত্রে কর ফাঁকির প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে তা কোনভাবেই তামাক কোম্পানির দাবি করা মাত্রার সমতুল্য নয়।

 দেশে কর ফাঁকির পরিমাণ কত?

বাংলাদেশে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে (এমআরপি)’ যেহেতু সব ধরনের পণ্য বিক্রি হয় সেহেতু সিগারেটও এমআরপিতে বিক্রি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি না করে মোড়কে উল্লিখিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।

তামাক কোম্পানির কারসাজি বন্ধ করতে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিধান/প্রজ্ঞাপনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনয়নের প্রস্তাব’করা হয়েছে।

সিগারেটের এমআরপি’র ওপর শতকরা হারে সরকার রাজস্ব পায়, ফলে এই বর্ধিত মূল্য থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। বর্ধিত মূল্যের পুরোটাই তামাক কোম্পানির পকেটে যাচ্ছে। এভাবে সুকৌশলে তামাক কোম্পানি রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এবছর যার সম্ভাব্য পরিমাণ হবে ৩,৭৮৪ কোটি টাকা।

চোরাচালানের আলোচন কখন বেশি হয়?

তামাক কোম্পানিগুলো কর ও মূল্য বাড়ানোর বিরোধিতা করে অনেকদিন ধরেই বলে আসছে যে করের উচ্চ হারের কারণে দেশে বিদেশী সিগারেটের চোরাচালান বেড়ে যাবে। তাদের মতে সীমান্তবর্তী এলাকার মাধ্যমে আশেপাশের নিকটবর্তী দেশগুলো থেকে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদেশি তামাক পণ্যের সরবরাহ বেড়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। তবে তাদের এই দাবিও সত্য নয়। কারণ বাংলাদেশের সাথে এশিয়ার অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সিগারেটের মূল্য তুলনা করলে দেখা যায় যে অন্য যেকোন দেশ থেকে বাংলাদেশে সিগারেটের মূল্য বেশ কম। বৈশ্বিক তামাক মহামারীর উপর করা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টেও একই তথ্য উঠে এসেছে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক সুশান্ত সিনহা সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, দেশে চোরাচালানের যে মিথ তামাক কোম্পানি প্রচার করে সেটার বাস্তবিক কোনো সত্যতা নেই। বরং তামাক কোম্পানিই এসব চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সাধারণত দেশে জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে এপ্রিল ও মে মাসেই গণমাধ্যমে চোরাচালান সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ চোরাচালানসংক্রান্ত সংবাদই প্রকৃতপক্ষে একই ধরণের। কারণ কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের লিখে দেওয়া সংবাদই সবগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।

দুই বছরের ১৩৯৮টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে সেখানে চোরাচালানের নিউজ খুব কম পাওয়া গেছে। আবার যেগুলো ছিলো সেসব প্রতিবেদনে চোরাচালানের পেছনে কারা রয়েছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকে না। এমনকি এসব চোরাচালানের জন্য কাউকে আটক করা হয়েছে— সেটিও উল্লেখ থাকে না। বেশিরভাগ সময় ‘তথাকথিত চোরাচালান করা সিগারেট’ বিমানবন্দরে লাগেজের পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আসলে বাস্তবে এসব তথ্যের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকে। বাজেটের আগে এ ধরনের সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো এনবিআর-এর সঙ্গে সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দরকষাকষি করে। তারা এমনভাবে তথ্য উপস্থাপন করে যেন সিগারেটের দাম বাড়ালে দেশে চোরাচালান বৃদ্ধি পাবে। তবে উৎপাদন ও রাজস্ব তথ্য বিশ্লেষণ করলে সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা প্রকাশ পায়।

চোরাচালান রোধে করণীয়

বিদ্যমান বিভিন্ন গবেষণার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, বাংলাদেশে অবৈধ বাণিজ্যের হার আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেই, তবুও একটি কার্যকর ‘ট্র্যাকিং ও ট্রেসিং সিস্টেম’ প্রবর্তন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবৈধ বাণিজ্যের মাত্রা আরও কমিয়ে এটিকে নগণ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রধান আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসির স্বাক্ষরকারী প্রথমদিককার দেশ হলেও বাংলাদেশ এখনো তামাকজাত দ্রব্যের অবৈধ বাণিজ্য নির্মূলের প্রটোকল স্বাক্ষর বা অনুমোদন করেনি। সেজন্য তামাকের অবৈধ বাণিজ্য রোধে নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো গ্রহণ ও কার্যকর করা যেতে পারে :

# বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অবৈধ বাণিজ্য বিষয়ক প্রটোকল (Illicit Tobacco Trade Protocol) অনুসমর্থনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।

# ব্যান্ডরোলের পুনঃব্যবহার রোধ করতে ব্যান্ডরোল ডিজিটালাইজেশন ও কিউআর কোড যুক্তসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।

# অবৈধ বাণিজ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন অনুসারে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। তামাকজাত দ্রব্যের প্রতিটি প্যাকেট আলাদা চিহ্নিত ও স্ক্যান করার জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে হবে।

# তামাকজাত দ্রব্য বিক্রিয়কেন্দ্রের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা। এটা করলে অবৈধ বাণিজ্য অনেক কমে আসবে।

একইসঙ্গে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে নিম্নোক্ত তথ্যসমূহ প্রযুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত করতে হবে-

ক) কোম্পানির নাম, উৎপাদনের তারিখ ও সিরিয়াল নম্বর।

খ) তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত মেশিন সম্পর্কিত তথ্য

গ) পণ্য পরিবর্তন ও উৎপাদনের সময়

ঘ) পণ্যের যথাযথ বিবরণ

ঙ) গুদামজাত ও স্থানান্তর সংক্রান্ত তথ্য

তথ্যসূত্র 

১. Abdullah, S. M., Huque, R., Bauld, L., Ross, H., Gilmore, A., John, R. M., . . . Siddiqi, K. (2020). Estimating the Magnitude of Illicit Cigarette Trade in Bangladesh: Protocol for a Mixed-Methods Study. International Journal of Environmental Research and Public Health.

২. World Bank. (2019). Confronting Illicit Tobacco Trade: A Global Review of Country Experiences. World Bank Group Global Tobacco Control Program.

৩. Ibid

৪. Abdullah, S. M., Huque, R., and others (2021). Magnitude, structure and associated factors of illicit cigarette sales in Bangladesh: a pack analysis. Link: https://tobaccocontrol.bmj.com/content/early/2025/06/04/tc-2024-059131

৫. WHO Report on the Global Tobacco Epidemic, 2021

৬. Singha, Sushanta kumar (2024). An Investigation of Bangladesh's Business-Friendly Cigarette Pricing and Way Forward. Link: https://bnttp.net/resource/an-investigation-of-bangladeshs-industry-friendly-cigarette-pricing-and-way-forward/

 

লেখক : সিনিয়র প্রজেক্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার, তামাক কর প্রকল্প, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।