ঢাকারবিবার , ৫ অক্টোবর ২০২৫
  • অন্যান্য

ছোট বাতি, বড় স্বপ্ন: গ্রামের শিশুদের পড়াশোনার গল্প

বিপ্লব হোসাইন
অক্টোবর ৫, ২০২৫ ১:১৪ অপরাহ্ণ । ২৬২ জন

নব্বই দশকের কথা মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধুলোবালি, খোলা মাঠের ধানক্ষেত আর সাদাকালো স্কুলের ঘর। সেই সময়ে গ্রামের ছেলেরা পড়াশোনার জন্য রোজ সকালে ঘরে ছোট বাতি জ্বালিয়ে পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাত। বিদ্যুতের স্বচ্ছলতা ছিল খুবই সীমিত। অনেকসময় তারা দুপুরে স্কুলে গিয়ে পড়ার সুযোগ পেত, কারণ সন্ধ্যায় ঘরে আলো ছিল প্রায় নেই।

সেই সময়ে গ্রামের জীবনযাত্রা এখনকার মতো সুবিধাজনক ছিল না। শিশুদের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল মাঠে কাজ করতে, ফসল ও গবাদিপশুর সাথে সাহায্য করতে। সেই অল্প সময়ের মধ্যে পড়াশোনা করা মানে ছিল দৃঢ় ধৈর্য, নিয়মিত অনুশীলন এবং এক ধরনের আত্মশৃঙ্খলা। ছোট খাটো সমস্যার সমাধান, বন্ধুদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর, শিক্ষকের কঠোর কিন্তু স্নেহময় দিকনির্দেশনা-সব মিলিয়ে ছাত্রদের মানসিক ও নৈতিক গঠন গড়ে তুলত।

শিক্ষকের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। তারা কেবল পাঠ্যবইয়ের বিষয় শেখাতেন না, বরং জীবনের শিক্ষা দিতেন। গল্পের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা, সহমর্মিতা, ধৈর্য এবং পরিশ্রমের মূল্য বোঝাতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছাত্র/ছাত্রীরা প্রতিদিন সকালে সূর্য উঠার আগেই ঘরে বসে অঙ্কের পৃষ্ঠা সমাধান করত, সন্ধ্যায় বাতি জ্বালিয়ে বাংলা ও ইংরেজি পাঠ নিয়ে মনযোগী হতো। সেই সময়ে গ্রামের প্রতিটি শিক্ষক ছিল ছাত্রদের জীবনের আলো।

কিন্তু বর্তমানে গ্রামের শিশুরা আর ধুলোবালি-আবদ্ধ স্কুলে বসে না। আধুনিক ক্লাসরুমে বিদ্যুত, ফ্যান, প্রজেক্টর, ইন্টারনেট-সবই রয়েছে। শিশুদের হাতে আছে ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ। তারা ভিডিও লেকচার দেখে, অনলাইন কুইজ সমাধান করে, ডিজিটাল রিসোর্স ব্যবহার করে পড়াশোনা করছে। শিক্ষকের ভূমিকা এখন নির্দেশক থেকে পরামর্শদাতা; তারা শিশুদের সৃজনশীলতা, সমাধান করার ক্ষমতা এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশে সাহায্য করছেন।

এছাড়া গ্রামের পরিবেশও পরিবর্তিত হয়েছে। আগে যেখানে মাটির পথ, ছোট্ট কুঁড়েঘর আর হাওরের মাঝখানে স্কুল ছিল, আজ সেখানে পাকা রাস্তা, ঝকঝকে নতুন ভবন এবং খেলাধুলার মাঠ রয়েছে। প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিশুরা বিশ্বমানের তথ্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। তবু গ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন রয়ে গেছে-শিশুরা স্কুলে বসে স্থানীয় অনুষ্ঠান, গান ও নৃত্যের সঙ্গে শিক্ষাকে সংযুক্ত করছে।

নব্বই দশকের স্কুলের ছাত্র/ছাত্রিরা যেমন ছোট বাতি জ্বালিয়ে রাতভর পড়ত, আজকের শিশুরা একই আগ্রহে ট্যাবলেটে অঙ্ক সমাধান করছে। সময় বদলেছে, মাধ্যম বদলেছে, তবে শেখার উৎসাহ, শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং গ্রামের সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে শিশুদের সম্পৃক্ততা এখনও অটুট।

এই গল্প শুধু প্রযুক্তি বা আধুনিকীকরণের নয়, বরং শিক্ষা ও শিক্ষকের গুরুত্বের স্থায়িত্বেরও। নব্বই দশকে যেখানে শিক্ষকের শব্দ ছিল মূল আলো, আজও শিক্ষকের দিকনির্দেশনা শিশুদের মননশীলতা ও জ্ঞান অর্জনের পথ আলোকিত করছে। সময় বদলেছে, মাধ্যম বদলেছে, কিন্তু শেখার উৎসাহ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বন্ধন এবং জ্ঞানের পিপাসা অটুট আছে।