সন্ধ্যাবেলা লাইব্রেরির নির্জনতায় বসে একজন শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটি তালিকার দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। তালিকাটি বিশ্বখ্যাত QS World University Rankings-এর। তার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানো, কিন্তু এখন সে ভাবছে—“আমার দেশ কোথায় এই তালিকায়?” এই প্রশ্নটি একা তার নয়; উন্নয়নশীল দেশগুলোর বহু শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও নীতিনির্ধারকদের মনে একই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে।
QS World University Rankings ২০২৫ সংস্করণ অনুযায়ী, শীর্ষ ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে—১৯৭টি। যুক্তরাজ্য আছে দ্বিতীয় স্থানে, ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। এরপর রয়েছে চীন, যার অবস্থান তৃতীয়, ৭১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। এই সংখ্যাগুলো শুধু সংখ্যাই নয়, বরং তারা নির্দেশ করে উচ্চশিক্ষায় সেই দেশগুলোর কতটা বিনিয়োগ, গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নতি ঘটেছে।
চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে জার্মানি ও ইতালি, প্রতিটিতে রয়েছে ৪৯টি করে বিশ্ববিদ্যালয়। অস্ট্রেলিয়া ৪৪টি, ভারত ৪০টির কাছাকাছি, স্পেন ও ফ্রান্স ৩৬টি করে, আর জাপান ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়কে শীর্ষ ১৫০০–তে ঠাঁই দিতে পেরেছে। এসব পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
QS র্যাঙ্কিং মূলত কয়েকটি সূচকের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়: শিক্ষকদের ও ছাত্রদের অনুপাত, শিক্ষকের গবেষণা অবদান, পাণ্ডিত্য ও উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড, কর্মসংস্থান ফলাফল, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অনুপাত, বৈশ্বিক গবেষণা নেটওয়ার্ক এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতি অবদান। প্রতিটি সূচকই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মান তুলে ধরে।
২০২৫ সালের র্যাঙ্কিংয়ে নতুন করে যোগ করা হয়েছে তিনটি সূচক:
১. Employment Outcomes — একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার গ্র্যাজুয়েটদের কতটা ভালো কর্মসংস্থানের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার পরিমাপ।
২. International Research Network (IRN) — বিশ্বব্যাপী গবেষণা সহযোগিতার পরিধি ও গভীরতা।
৩. Sustainability — পরিবেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে অবদান।
এই সূচকগুলো যুক্ত হওয়ার ফলে উন্নয়নশীল দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কিছুটা উন্নত হয়েছে, কারণ তারা স্থানীয়ভাবে টেকসই উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় যুক্ত হয়েছে।
যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ৩৮-৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তালিকায় উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে, বাংলাদেশ এখনো বিশ্বসেরা ১০০০ বা ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নিয়মিত প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। ঢাবি, বুয়েট বা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান QS বা Times Higher Education-এর আঞ্চলিক তালিকায় এলেও তারা এখনো বৈশ্বিক শীর্ষস্থান থেকে অনেক দূরে।
বাংলাদেশের সমস্যা কেবল অবকাঠামোগত নয়, বরং গবেষণায় তহবিলের অভাব, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা কম হওয়া এবং শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতের ভারসাম্যহীনতাও র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে পড়ার কারণ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গবেষণাকেন্দ্রিক পরিবেশ ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতা এখনো দুর্বল।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু দেশ, যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ আফ্রিকা উচ্চশিক্ষায় বিপুল বিনিয়োগ করে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে তালিকায় নিয়ে আসতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবের ১৮টি এবং ইউএই-এর ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় এখন শীর্ষ তালিকায় রয়েছে, যেখানে গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের এগিয়ে দিয়েছে।
চীনের অগ্রগতি এক কথায় বিস্ময়কর। মাত্র দুই দশক আগেও তারা ছিল তালিকার বাইরের খেলোয়াড়, এখন তারা তৃতীয় অবস্থানে। চীনের সরকার পরিকল্পিতভাবে উচ্চশিক্ষায় বিপুল বিনিয়োগ করেছে, বিদেশি শিক্ষক ও গবেষকদের আকৃষ্ট করেছে, এবং আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ের সূচকগুলো মাথায় রেখে উন্নয়ন কৌশল তৈরি করেছে।
ইউরোপের দেশগুলো, বিশেষত জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম—শুধু গবেষণার গুণগত মানে নয়, বরং নৈতিকতা ও পরিবেশবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থার কারণে এগিয়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় টেকসই ক্যাম্পাস গড়ে তুলেছে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহার করেছে এবং বৈশ্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
তবে এই প্রতিযোগিতার ভেতরেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই তালিকাগুলো কি সত্যিই শিক্ষার গুণগত মান প্রকাশ করে? অনেকেই বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাস্তবতা আলাদা। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থানীয় সমস্যা সমাধানে নিবেদিত থাকলেও আন্তর্জাতিক সূচকে এগোতে পারছে না, কারণ র্যাঙ্কিংয়ের সূচকগুলো পশ্চিমা মানদণ্ড অনুযায়ী তৈরি। তবু, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে এসব তালিকা বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা পছন্দ নির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি হয়ে উঠেছে একটি র্যাঙ্কিং-কেন্দ্রিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা। সরকারের উচিত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ফান্ড বাড়ানো, আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেওয়া, এবং দেশি-বিদেশি যৌথ গবেষণায় বেশি মনোযোগ দেওয়া। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং গবেষণার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ের এই প্রতিযোগিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষা কেবল একটি জাতীয় বিষয় নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক প্রয়াস। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি শিক্ষক এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীই এই বৈশ্বিক মানচিত্রে একটি বিন্দু, যারা একসঙ্গে জ্ঞান, উদ্ভাবন এবং অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। আজ যেসব দেশ তালিকার শীর্ষে, তারাও একসময় ছিল পিছিয়ে। বাংলাদেশও যদি এখন থেকেই পরিকল্পিতভাবে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ শুরু করে, তাহলে আগামী এক দশকের মধ্যেই হয়তো আমাদের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় দৃশ্যমান হয়ে উঠবে—এমন আশাই আমাদের প্রেরণা হয়ে উঠুক।