ঢাকাবৃহস্পতিবার , ১৫ মে ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম মজুরিতে কাজ করেন বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা

রঞ্জন কুমার দে
মে ১৫, ২০২৫ ২:১৩ অপরাহ্ণ । ১৫৭ জন

চা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। কিন্তু এই শিল্পের মূলে যাঁরা—চা শ্রমিকেরা—তাঁদের জীবন বাস্তবতা এক অবর্ণনীয় নিপীড়নের কাহিনি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চা শ্রমিকরাই সবচেয়ে কম মজুরিতে কাজ করছেন। সরকারি হিসাবে তাদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭০ টাকা, যা ১.৪২ মার্কিন ডলার সমতুল্য। এই মজুরি শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বিশ্বের অন্যতম নিম্নতম মজুরির মধ্যে পড়ে।

অন্যদিকে, প্রতিবেশী ভারতেই একই খাতে শ্রমিকরা এর চেয়ে অনেক বেশি মজুরি পান। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের আসামে দৈনিক মজুরি ৩৫৬ টাকা, কেরালায় ৬৮৭ টাকা, তামিলনাড়ুতে ৬৪০ টাকা এবং সিকিমে ৭১১ টাকা। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নেপালেও চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩৮৭ টাকা।

এই চরম বৈষম্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশি চা শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। শ্রমিকদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত না করে শুধুমাত্র উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া নির্মমতা ছাড়া আর কিছু নয়।

চা শ্রমিকদের বাস্তবতা: কোন অধিকার নেই, কোন ভবিষ্যৎ নেই
বাংলাদেশের চা শিল্পে প্রায় ১ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যাঁদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের কোনো স্থায়ী নিয়োগপত্র নেই। ৮৭ শতাংশের নেই কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র, এবং ১০০ শতাংশ শ্রমিকের সার্ভিস বুক পর্যন্ত নেই, যা তাদের চাকরির ইতিহাস ও অধিকার প্রমাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অধিকন্তু, শ্রমিকদের ৯৭ শতাংশই স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্ষালন (টয়লেট) সুবিধা পান না। ৬৮ শতাংশ শ্রমিক পরিবার সন্তান দিবা-পরিচর্যা কেন্দ্রের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যার ফলে নারীরা সহজে কাজ করতে পারেন না, এবং শিশুদের প্রাথমিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয় না। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, দেশের ৪০টি চা বাগানে বাগান কর্তৃপক্ষের কোনো স্কুল নেই, এবং ৬টি বাগানে কোনো স্কুলই নেই। যেখানে স্কুল রয়েছে, সেখানে নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক, পাঠ্যবই বা শিক্ষার পরিবেশ।

ভূমির অধিকারহীন জীবন ও দারিদ্র্যচক্রে বন্দি ভবিষ্যৎ
চা শ্রমিকরা যুগের পর যুগ ধরে একই বাগানে বসবাস করলেও, তাঁদের ভূমির মালিকানা নেই। ফলে তাঁরা শুধু শ্রমিকই নয়, বাস্তবে এক ধরনের ‘বাধ্যতামূলক বসতি’র বাসিন্দা—যা একরকম আধুনিক দাসত্বের মতো। ৮০ শতাংশ শ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন, যার অর্থ তাঁরা দৈনন্দিন জীবন চালাতে গিয়ে খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত।

সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য রাষ্ট্র এবং নীতিনির্ধারকদের দায়
চা শ্রমিকদের এই করুণ অবস্থার জন্য শুধু বাগান মালিক নয়, বরং রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারে না। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে এক নির্মম উদাসীনতা আজো বিরাজমান।

সমাধানের পথ ও জরুরি পদক্ষেপ

১. দৈনিক মজুরি অন্তত ৩০০ টাকায় উন্নীত করা।
২. স্থায়ী নিয়োগপত্র এবং পরিচয়পত্র প্রদান বাধ্যতামূলক করা।
৩. সকল শ্রমিকের সার্ভিস বুক চালু করা ও ডিজিটাল রেকর্ড রাখা।
৪. বাগানে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, নিরাপদ পানি ও ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন।
৫. বাগান এলাকায় সরকারি বা সহযোগিতামূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
৬. চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা, অন্তত বসতভিটার উপর মালিকানা দেওয়া।
৭. চা শ্রমিকদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালু করা।

চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক কর্তব্য। এই শ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, অথচ তাঁদের জীবন কেবলই অবহেলা আর বঞ্চনার গল্প হয়ে আছে। সময় এসেছে—তাঁদের সেই অব্যক্ত কষ্টের প্রতি সমাজ, সরকার এবং আমরা সবাই সজাগ দৃষ্টি দিই।