ঢাকাসোমবার , ৫ মে ২০২৫

জলের বুকেই দাঁড়িয়ে থাকা শহর: ভেনিসের জন্মকথা ও তার টিকে থাকার বিস্ময়

নিজস্ব প্রতিবেদক
মে ৫, ২০২৫ ৫:৩৪ অপরাহ্ণ । ১২৬ জন

ভোরের আলোর মতো নিঃশব্দে একদল মানুষ এগিয়ে চলেছে উত্তরের দিকে। পেছনে পুড়ে যাওয়া শহর, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। রোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে, চারদিকে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর নৃশংসতা। এই ভয়াল সময়েই কিছু সাহসী পরিবার আশ্রয় খুঁজে নেয় ইতালির উত্তর-পূর্বের অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের এক বিস্তীর্ণ ল্যাগুনে, যেখানে স্থলভাগের বদলে জল, কাদামাটি আর অগভীর খাল ছাড়া আর কিছু নেই। তাদের তখনও জানা ছিল না, তারা ইতিহাস গড়তে চলেছে—জলের বুকে এক শহর গড়ে তুলবে, যার নাম হবে ভেনিস (Venice)।

এই শহরটির জন্মকথা শুধুই ইতিহাসের অধ্যায় নয়, এটি প্রকৌশলের এক অবিশ্বাস্য কীর্তিও বটে। “Venice wasn’t built on solid ground”—এ বাক্যটি কেবল রূপক নয়, এটি নিছক বাস্তব। ভেনিস আসলে গড়ে উঠেছিল এমন এক জায়গায়, যেখানে কোনো দৃঢ় ভূখণ্ডই ছিল না। ছিল জলজ উদ্ভিদে ভরা অস্থির জমি, কাদাপাঁক আর চরে ভরপুর এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি। তবুও সেই অনুপযুক্ত ভূমিতেই মানুষের অধ্যবসায়, প্রযুক্তি আর সাহসিকতার জোরে দাঁড়িয়ে গেছে এক সমৃদ্ধ, সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক মহানগরী।

ভেনিসের শুরু: পালিয়ে এসে গড়ে তোলা এক শহর
৫ম শতাব্দীর দিকে হুন, গোথ, লম্বার্ডদের মতো বর্বর গোষ্ঠীগুলোর আগ্রাসনে ইতালির মূল ভূখণ্ডে নিরাপদ জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই সময় রোমান নাগরিকদের একটি বড় অংশ এই অগভীর ল্যাগুনে আশ্রয় নেয়, যাকে এখন বলা হয় Venetian Lagoon। এই অঞ্চলটি প্রায় ৫৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যেখানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১১৮টি দ্বীপ রয়েছে।

প্রথমে এই ল্যাগুনে সাময়িকভাবে বাস করতে চাইলেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—এখানে কোনো কঠিন মাটি নেই যেখানে ভবন তৈরি করা যায়। এখানে ভবিষ্যৎ গড়া মানে ছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা।

কাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শহর
ভেনিসবাসীদের সবচেয়ে অসাধারণ কীর্তি ছিল কাঠের খুঁটির ওপর গোটা শহর নির্মাণ। দূরের পাহাড়ি এলাকা থেকে গজারি, লার্চ, এল্ডারসহ নানা ধরনের কাঠ এনে পানির নিচে ঠেলে দেওয়া হতো। প্রতিটি কাঠের খুঁটি ৪ থেকে ৮ মিটার লম্বা, আর কখনও কখনও আরও বড় হতো। খুঁটিগুলো কাদার স্তর পেরিয়ে শক্ত স্তর পর্যন্ত ঠেলে বসিয়ে দেওয়া হতো। এরপর খুঁটিগুলোর ওপর কাঠের ফ্রেম দিয়ে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হতো এবং তার ওপর বসানো হতো পাথরের ব্লক—প্রধানত ইস্ট্রিয়ান লাইমস্টোন, যা জলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না।

এই কাঠের খুঁটিগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তারা অক্সিজেনবিহীন পানির নিচে পচে না গিয়ে বরং খনিজ জমে জমে আরও শক্ত হয়ে যায়। ফলে শত শত বছর পরেও এই খুঁটি আজও বহন করছে গির্জা, প্রাসাদ, বাজার আর সেতুর ওজন।

প্রকৌশলের জয়: বাস্তব উদাহরণ
সেন্ট মার্কস ব্যাসিলিকা (Basilica di San Marco) নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল প্রায় ১০,০০০ কাঠের খুঁটি। রিয়াল্টো ব্রিজ (Rialto Bridge) নির্মাণে প্রয়োজন হয়েছিল প্রায় ১২,০০০ খুঁটি। এই কাঠামো নির্মাণ ছিল একাধারে সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং কৌশলগতভাবে জটিল, কিন্তু এই প্রয়াসই ভেনিসকে এক অনন্য শহরে পরিণত করে।

জলবায়ুর চাপ ও আধুনিক চ্যালেঞ্জ
বর্তমান সময়ে ভেনিস এক গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। শহরটি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে—প্রতি বছর ১–২ মিলিমিটার করে। এর পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ কাজ করছে:

১. মাটির বসে যাওয়া (subsidence)

২. ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ইতিহাস (যদিও বর্তমানে নিষিদ্ধ)

৩. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন

বিশেষ করে Acqua Alta, অর্থাৎ উচ্চ জোয়ারের সময় শহরের বড় অংশ পানিতে ডুবে যায়। ২০১৯ সালে ভেনিসে ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়, যখন সেন্ট মার্কস স্কয়ার প্রায় ১.৮৭ মিটার পানির নিচে চলে গিয়েছিল।

প্রতিকার প্রচেষ্টা: MOSE প্রকল্প
এই জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ইতালীয় সরকার বহু বছর আগে MOSE Project চালু করে। এটি একটি বিশাল বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যার আওতায় ভেনিসের তিনটি মুখে (Lido, Malamocco, Chioggia) অস্থায়ী গেট তৈরি করা হয়েছে। জোয়ার বেশি হলে এই গেটগুলো উঠে এসে সমুদ্র থেকে পানি প্রবেশ আটকে দেয়।

তবে, প্রায়শ বিলম্ব, দুর্নীতি ও বাজেট সমস্যার কারণে এই প্রকল্পটি ২০০৩ সালে শুরু হলেও পূর্ণভাবে কার্যকর হয় ২০২১ সালে। এখনো তা একে বারেই নির্ভরযোগ্য নয়।

আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
ভেনিস শুধু একটি শহর নয়, এটি একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য (World Heritage Site)। এর প্রাকৃতিক গঠন, স্থাপত্যশৈলী ও শিল্পকলা বিশ্ববাসীর কাছে অনন্য। কিন্তু জলবায়ু সংকট ও পর্যটনের চাপে এটি আজ হুমকির মুখে।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা এখন ভেনিস রক্ষায় কাজ করছে। কিছুদিন আগেই ভেনিস পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পর্যটন ফি চালু করেছে, যাতে অতিরিক্ত চাপ থেকে শহরটিকে রক্ষা করা যায়।

উপসংহার
ভেনিসের জন্ম এক রূপকথার মতো হলেও তার অস্তিত্ব বাস্তবের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এটি একটি শহর যা জলের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও ইতিহাস, শিল্প আর প্রযুক্তির গৌরব বয়ে বেড়ায়। আজও তার প্রতিটি সেতু, গির্জা আর খাল যেন বলে চলে মানুষের অদম্য সৃষ্টিশীলতার গল্প। তবে সময় এসেছে সেই গৌরবকে রক্ষা করার—বিচারবোধ, বিজ্ঞান ও সচেতনতার মেলবন্ধনে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বলতে পারে: একসময় কিছু মানুষ কাদার বুকে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখেছিল, আর সেই স্বপ্নই আজ ভেনিস।