বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রায় এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে যখন ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্স-এর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক ২০২৫ সালের ২০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। সরকারি কর্মকর্তারা একে যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেন, যেটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে। তাঁদের মতে, এটি এমন একটি প্রযুক্তি, যা কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা আন্দোলনের সময়েও বন্ধ করা যাবে না। এমন বক্তব্যে অনেকেই আশান্বিত হয়েছেন, তবে অনেকে এটিকে একধরনের বিপজ্জনক ফাঁদ বলেও চিহ্নিত করছেন। প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি সত্যিকারের ইন্টারনেট স্বাধীনতার পথ? নাকি বিদেশি প্রযুক্তির মোড়কে এক নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণের উপকরণ?
স্টারলিংকের মূল প্রতিশ্রুতি হলো সারা দেশে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায়, ফাইবার অপটিকের বিকল্প হিসেবে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে অপারেটররা ব্রডব্যান্ড লাইন বসাতে আগ্রহী হন না, কারণ এতে খরচ বেশি, লাভ কম। ফলে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক সংযোগ সেখানে একটি নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই দিগন্তে প্রবেশের খরচ কতটা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে?
বর্তমানে স্টারলিংক বাংলাদেশে দুটি রেসিডেন্সিয়াল প্যাকেজ চালু করেছে। একটি হলো “রেসিডেন্সিয়াল লাইট”, যেখানে প্রতি মাসে ৪২০০ টাকা খরচ করে সীমাহীন ডেটা পাওয়া যায়, তবে কম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গতিতে। অন্যটি হলো “রেসিডেন্সিয়াল”, যার জন্য প্রতি মাসে গুণতে হয় ৬০০০ টাকা। এই উভয় প্যাকেজেই আলাদা করে একটি সেটআপ কিট কিনতে হয় যার খরচ ৪৭,০০০ টাকা। ফলে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবায় প্রথম মাসে প্রবেশ করতেই একজন ব্যবহারকারীর খরচ হয় প্রায় ৫১,২০০ থেকে ৫৩,০০০ টাকা। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ নাগরিকের নাগালের বাইরে। যেখানে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরেও ১০০ এমবিপিএস ব্রডব্যান্ড সংযোগ ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, সেখানে এত উচ্চমূল্যের সেবা কতটা কার্যকরভাবে দেশের ডিজিটাল বৈষম্য কমাবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
মূলত সরকার বলছে, স্টারলিংক এমন একটি প্রযুক্তি, যা তারা চাইলেও বন্ধ করতে পারবে না। এ বক্তব্যে অনেক প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষ আশ্বস্ত হচ্ছেন, ভাবছেন যে সরকার আর ইচ্ছেমতো ইন্টারনেট বন্ধ করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) কর্তৃক স্টারলিংককে দেশে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় লাইসেন্স নিতে হবে, দেশের অভ্যন্তরে গেটওয়ে বসাতে হবে এবং সেখান থেকে ডেটা ট্রাফিক চালাতে হবে—এই শর্ত দেওয়া হয়েছে। তার মানে, দেশের সীমানার ভেতর স্টারলিংককে কার্যত সরকারের নির্দেশ মানতেই হবে। এমনকি প্রয়োজন হলে সরকার সেবাটি সাময়িকভাবে বন্ধ করার ক্ষমতাও রাখবে। তাই এ দাবি যে এটি ‘নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত’ একটি প্রযুক্তি, সেটি প্রকৃতপক্ষে ভুল ধারণা ছড়ানোর শামিল। প্রযুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সরকার যদি আইএসপিগুলোর ওপর যে রকম চাপ প্রয়োগ করতে পারে, তা স্টারলিংকের ক্ষেত্রেও কার্যকর করতে পারবে, কারণ তাদের সরঞ্জাম এবং গেটওয়ে থাকবে দেশের মাটিতে।
এখানে আরেকটি বড় উদ্বেগ হলো গোপনীয়তা ও নজরদারি। স্টারলিংক একটি মার্কিন কোম্পানি, এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের CLOUD Act-এর আওতাধীন। এই আইনের অধীনে, মার্কিন সরকার চাইলে কোনো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানির সংগ্রহ করা ডেটা অ্যাক্সেস করতে পারে, এমনকি সেটি বিদেশি নাগরিকের হলেও। অর্থাৎ, স্টারলিংকের মাধ্যমে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের কার্যক্রমের ওপর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারির ঝুঁকি বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, স্পেসএক্স, যেটি স্টারলিংকের মূল কোম্পানি, তাদের একাধিক প্রতিরক্ষা সংস্থা ও এমনকি CIA-এর সাথেও চুক্তি রয়েছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক এবং বেসরকারি প্রযুক্তির মেলবন্ধন একটি বাস্তবতা, এবং সেখানকার অনেক টেক জায়ান্টই সরাসরি মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হয়ে কাজ করে থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো একটি ভূরাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অঞ্চলে, যেখানে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতা দিন দিন জটিল হচ্ছে, সেখানে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তাহলে কি দেশের সার্বভৌমত্ব কোনো হুমকির মুখে পড়বে না? বাংলাদেশের স্টারলিংক অনুমোদনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের “ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল” গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলেই অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। বাংলাদেশে কোনো রকম সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা না গেলেও, যদি মার্কিন ইন্টারনেট ও যোগাযোগ অবকাঠামো এখানে প্রবেশ করে, তবে তা হতে পারে এক প্রকার “ডিজিটাল উপস্থিতি” যা ভবিষ্যতে কৌশলগত সুবিধা এনে দিতে পারে। সেই দিক থেকে স্টারলিংকের মাধ্যমে শুধু প্রযুক্তি নয়, বরং একটি বিশেষ ভূরাজনৈতিক বলয়েরও আগমন ঘটেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কি একটি বিকল্প ব্যবস্থার পথে হাঁটছি, না কি নতুনভাবে একটি একচেটিয়া ও নজরদারিমূলক কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করছি? সরকার যে স্টারলিংককে একটি “মুক্ত” প্রযুক্তি হিসেবে প্রচার করছে, তা কি সত্যিকার অর্থে স্বতন্ত্র নাকি কৌশলগতভাবে পরিকল্পিত একটি মার্কিন প্রভাব বিস্তার নীতি?
এতসব তথ্য ও বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট, স্টারলিংক একটি দ্বৈত বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। একদিকে এটি প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, অদূর ভবিষ্যতে দুর্ভোগপীড়িত অঞ্চলে দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে সক্ষম, যেটি জরুরি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রশাসনিক সেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অন্যদিকে এর আর্থিক অপ্রাপ্যতা, বৈশ্বিক নজরদারি কাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্টতা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা এটিকে একটি সতর্কতা ও সচেতন বিশ্লেষণের বিষয় করে তোলে।
বাংলাদেশের জনগণের সামনে এখন এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ: স্টারলিংক কি তাদের ডিজিটাল স্বাধীনতার যাত্রায় সহায়ক হবে, না কি এটি হবে একধরনের প্রযুক্তিগত ঔপনিবেশিকতা, যার মাধ্যমে বিদেশি শক্তি দেশীয় তথ্য পরিকাঠামো ও ব্যবহারকারীদের উপর এক নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে? এমন প্রশ্নের উত্তর এখনই চূড়ান্তভাবে দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এই প্রযুক্তিকে গ্রহণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আলোচনার সুযোগ, তথ্যের স্বচ্ছতা এবং ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা—এই তিনটি দিক অগ্রাধিকার দেওয়া না হলে, ভবিষ্যতে স্টারলিংক একধরনের নব্য-নিয়ন্ত্রণমূলক নেটওয়ার্কে রূপ নিতে পারে।
তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্টারলিংককে কেবল একটি প্রযুক্তি নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও নীতিগত ইস্যু হিসেবেই দেখার সময় এসেছে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল স্বাধীনতা চাই, তবে আমাদের প্রয়োজন স্বাধীন পরিকাঠামো, সাশ্রয়ী সেবা, এবং জাতীয় স্বার্থে স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রযুক্তি বেছে নেওয়ার সদিচ্ছা। তা না হলে ‘স্বাধীনতার’ মোড়কে এক নতুন ‘ফাঁদে’ জড়িয়ে পড়াও অনিবার্য হয়ে উঠবে।