ঢাকাবুধবার , ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
  • অন্যান্য

পাঁচজনের চারজন নারী স্বামীর সহিংসতার শিকার: আইসিডিডিআরবি গবেষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫ ২:৫০ অপরাহ্ণ । ৯৭ জন

বাংলাদেশের নববিবাহিত নারীদের মধ্যে স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ ও সহিংসতা ব্যাপক। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর দুই বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে পাঁচজনের মধ্যে চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। একই সময়ে দুই বছরের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী আর্থিক সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন। পাশাপাশি মানসিক, শারীরিক ও যৌন সহিংসতার ঘটনাও নজরে এসেছে।

বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) আইসিডিডিআরবির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে “বাংলাদেশের নির্বাচিত গ্রামীণ ও শহরাঞ্চল নববিবাহিত দম্পতিদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট ও চাহিদা নিরূপণ” শীর্ষক গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

দুই বছর মেয়াদী “গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা”র অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণাটি বাংলাদেশে এই ধরণের প্রথম দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা, যেখানে গ্রাম ও শহরের বস্তি এলাকার নবদম্পতিদের বিয়ের পরবর্তী জীবন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত গ্রামীণ এলাকা ও শহরের বস্তি এলাকায় নববিবাহিত দম্পতিদের জীবনে অল্প বয়সে বিয়ে, দ্রুত গর্ভধারণ এবং দাম্পত্য সহিংসতা এখনো উদ্বেগের বিষয়। গবেষণায় অংশ নেয়া নারীদের মধ্যে গ্রামে ৪৩% এবং শহরের বস্তিতে ৬৫% নারী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের প্রথম বছরে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (৭৩%) নারী গর্ভধারণ করছে, অথচ অনেক নারী, বিশেষ করে শহরের বস্তিতে বসবাসকারী নারীরা, কিছুটা দেরিতে সন্তান নিতে চেয়েছিলেন। প্রায় অর্ধেক নারীর গর্ভধারণ-ই ছিল অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগেই। গবেষণায় দাম্পত্য সহিংসতার চিত্রও উদ্বেগজনক অবস্থায় দেখা গিয়েছে। বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পাঁচজনের মধ্যে চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হওয়ার কথা জানান। দুই বছরে অর্ধেকের বেশি নারী আর্থিক সহিংসতা এবং উল্লেখযোগ্য অংশ মানসিক, শারীরিক ও যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।

আইসিডিডিআরবির জানিয়েছে, ডিসেম্বর ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত আইসিডিডিআর, বি-র চারটি হেলথ অ্যান্ড ড্যামোগ্রাফিক সার্ভিলেন্স সিস্টেম (এইচডিএসএস) এলাকায় এই মিশ্র-পদ্ধতির গবেষণাটি পরিচালিত হয়। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার দম্পতিরা। এছাড়া শহরের বস্তিগুলোর মধ্যে বেছে নেয়া হয়েছিল ঢাকার মিরপুর ও কড়াইল। মোট ৬৬৬ নববিবাহিত দম্পতি এতে অংশ নেন। গবেষণার অংশগ্রহণের জন্য যাদের প্রথম বিয়ে এবং বিয়ের সময়কাল ছিল ছয় মাসের কম এবং যাদের পূর্বের কোনো গর্ভধারণের ইতিহাস ছিল না এমন দম্পতিদেরকেই বেছে নেয়া হয়েছিল। প্রতি চার মাস অন্তর দম্পতিদের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়, অর্থাৎ দুই বছরে মোট ছয় দফা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

আইসিডিডিআরবি আরও জানায়, গবেষণায় বিয়ের পরের পরিবর্তন, সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা, দাম্পত্য সহিংসতা এবং বৈবাহিক জীবনে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হয়। এরমধ্যে অল্প বয়সে বিয়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। নারীদের মধ্যে গ্রামে ৪৩% এবং শহরের বস্তিতে ৬৫% নারী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে করেছেন। পুরুষদের মধ্যে গ্রামে ১৫% এবং শহরে ৩৭% পুরুষ ২১ বছরের আগেই বিয়ে করেছেন। কম বয়সে বিয়ে করা নারীদের বেশিরভাগেরই বিয়ে পারিবারিকভাবে ঠিক করা হয়েছিল-গ্রামে ৮৫% এবং শহরে ৫৩%।

সংস্থাটি জানায়, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারী বিয়ের পরপরই গ্রামে ৬০% এবং শহরে ৬৬% পড়াশোনা বন্ধ করেছেন। এর পেছনে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আপত্তি, বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত, বিয়ের পর বাসস্থান পরিবর্তন, সামাজিক রীতি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা কাজ করেছে। আয়মূলক কাজের ক্ষেত্রেও একই ধরনের বাধা দেখা গেছে, যেখানে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নিয়ন্ত্রণ নারীদের কাজের সুযোগকে প্রভাবিত করেছে। এরমধ্যে ৪৭% অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগে গর্ভধারণের তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রামের অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় শহরের এই হার তিন গুণের বেশি।

গবেষণার দেখা গেছে, মোট ৭৩% নারী গর্ভধারণ করেছেন, বেশিরভাগই বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই। শহরের ৬৮% নারী অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে চাইলেও, ৬৭% নারী ওই সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে পড়েন। গর্ভনিরোধক ব্যবহারে শুরুতে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য ছিল-শহরে ব্যবহার বেশি, গ্রামে কম। তবে বিয়ের প্রায় ১৮ মাস পর উভয় এলাকায় ব্যবহার প্রায় একই পর্যায়ে আসে। এটি নবদম্পতিদের মধ্যে দ্রুত সন্তান নেওয়ার প্রবণতাকে নির্দেশ করে।

এছাড়া গবেষণায় দাম্পত্য সহিংসতার প্রাথমিক অভিজ্ঞতাও উঠে এসেছে। বিয়ের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই ৭৯% অর্থাৎ প্রায় পাঁচ জনের চার জন নারী স্বামীর দ্বারা নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের কথা জানান। দুই বছরে ৫২% নারী আর্থিক সহিংসতা, ২৩% মানসিক সহিংসতা, ১৫% শারীরিক সহিংসতা এবং ১৪% যৌন সহিংসতার শিকার হন। মাত্র ৪% নারী জানান যে, এই সময়ে তারা কোনো ধরনের সহিংসতার অভিজ্ঞতা পাননি। দাম্পত্য সন্তুষ্টির মাত্রাও সময়ের সঙ্গে বদলেছে। গবেষণার শুরুতে পুরুষরা নারীদের তুলনায় বেশি সন্তুষ্টির কথা জানান। সময়ের সঙ্গে উভয়ের সন্তুষ্টি কমেছে এবং এক পর্যায়ে স্থিতিশীল হয়েছে, তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই পতন তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।

আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও এই গবেষণার প্রধান গবেষক ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা, সহকারী বিজ্ঞানী তারানা-ই-ফেরদৌস এবং রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ যৌথভাবে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।

সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অ্যাডসার্চের প্রকল্প সমন্বয়কারী ও সহযোগী বিজ্ঞানী আনিসুদ্দিন আহমেদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন অ্যাডসার্চের প্রকল্প পরিচালক ও সিনিয়র সায়েন্টিস্ট (এমেরিটাস) ড. শামস এল আরেফিন।

সেমিনারে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানূর রহমানের সঞ্চালনায় একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফী, ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান, ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের ডা. রোকসানা ইয়াসমিন।

এসময় বক্তারা বলেন, দেশে সাড়ে তিন কোটি শিশু রয়েছে। ১৮ বছরের আগে অনেক বিয়ে হচ্ছে। ১২৫৩টি সেন্টারের মাধ্যমে সারাদেশে সচেতন করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহের সুফল এবং কুফল বুঝতে পারলে অনেকেই সচেতন হবে। বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি প্রান্তিক ও গ্রাম পর্যায়ে।