ঢাকারবিবার , ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
  • অন্যান্য

দারিদ্র্য, যুদ্ধ নাকি জলবায়ু? গৃহহীনতার আসল কারণ কী

নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিসেম্বর ৭, ২০২৫ ১২:২১ অপরাহ্ণ । ৪৭ জন

বিশ্বব্যাপী গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, আর এই বৃদ্ধি উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান বলছে, উন্নয়নশীল দেশ থেকে শুরু করে ধনী রাষ্ট্র- গৃহহীনতা আজ এমন এক বাস্তবতা, যা বিশ্বমানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। উইকিপিডিয়ার সাম্প্রতিক তালিকা, OECD-এর গৃহহীনতা বিষয়ক বিশ্লেষণ এবং World Population Review-এর তথ্য একত্রে পর্যালোচনা করলে একটি গভীর সংকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে- বিশ্বের বড় অংশের মানুষ আজ নিরাপদ আশ্রয় থেকে বঞ্চিত।

দক্ষিণ এশিয়া আজ গৃহহীনতার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে সমস্যাপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারতের জনসংখ্যার চাপ, দীর্ঘদিনের দারিদ্র্য এবং দ্রুত নগরায়নের প্রভাব মিলিয়ে তিনটি দেশেরই বিশাল জনগোষ্ঠী স্থায়ী আশ্রয়বিহীন জীবনে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নদীভাঙন, বন্যা ও উপকূলীয় ক্ষয়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক প্রভাব লাখো মানুষকে ঘরছাড়া করছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার যেসব দেশে একাধিক সংঘাত চলছে- যেমন ইয়েমেন, সিরিয়া, সোমালিয়া ও সুদান- সেখানকার গৃহহীনতা এখন যুদ্ধ ও বাস্তুচ্যুতির অনিবার্য ফল। এই দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষ নিরাপদ আশ্রয় হারিয়ে বছরের পর বছর শরণার্থী শিবির বা খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটাচ্ছেন। শুধু খাদ্য বা চিকিৎসাসেবার ঘাটতি নয়- আগ্রাসন, সহিংসতা, রোগব্যাধি ও অনিরাপত্তার একটি স্থায়ী চক্র তাদের জীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

আফ্রিকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে গৃহহীনতা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির জটিল সমন্বয়ে। দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, জিম্বাবুয়ে, মালি, চাদ ও ইথিওপিয়া- এসব দেশের জনগণ বহুদিন ধরে অসম উন্নয়ন ও অনিরাপদ পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছেন, যার ফলে তাদের বড় অংশই শেষ পর্যন্ত মাথার ওপর ছাদ হারিয়েছেন।

অনেকের ধারণা, গৃহহীনতা মূলত দরিদ্র দেশগুলোর সমস্যা- কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। এগুলো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হলেও অতিমূল্য আবাসনব্যবস্থা, সামাজিক বৈষম্য, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিস্তার, আসক্তি এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা মানুষকে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। বড় শহরগুলোতে পার্ক, ফুটপাত, স্টেশন, ব্রিজের নিচে কিংবা অস্থায়ী আশ্রয়ে রাত কাটানো মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গৃহহীনতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো অভিবাসন ও আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি। নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, স্পেন, ইতালি ও বেলজিয়ামে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সেবা ও আবাসন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শীতপ্রবণ দেশগুলোতে তা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, কারণ ঠান্ডায় আশ্রয়হীন মানুষের মৃত্যু হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশে দুর্নীতি, সংগঠিত অপরাধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষের জীবনে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে, যার ফলে অনেক মানুষ স্থায়ী আবাসন হারিয়ে ফেলে অনিরাপদ ও বিপজ্জনক পরিবেশে বসবাস করছেন। ব্রাজিল, পেরু, হন্ডুরাস, কলম্বিয়া ও গুয়াতেমালা এই সংকটের জটিল চিত্র তুলে ধরে।

বিশ্বব্যাপী গৃহহীন মানুষ গণনার পদ্ধতি দেশভেদে ভিন্ন হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যাটি তথ্যের তুলনায় আরও বেশি হতে পারে। অনেক দেশ কেবল রাস্তায় থাকা মানুষকে গৃহহীন হিসেবে গণনা করে, আবার কোথাও বস্তির অস্থায়ী ও অনিরাপদ বসতিতেও মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শরণার্থী শিবির, দুর্যোগপীড়িত এলাকা ও অনিবন্ধিত অভিবাসীদের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ আরও কঠিন হয়ে পড়ে, যার ফলে সরকারি পরিসংখ্যানে তার প্রতিফলন পাওয়া যায় না।

গৃহহীনতা মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমাত্রিক নীতির প্রয়োজন। শুধু অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করলেই সমাধান হবে না; সাশ্রয়ী আবাসন নীতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, আসক্তি-নিরাময় ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা জোরদার, দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ নিরাপত্তা কাঠামো প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী এবং স্থানীয় সরকারকে সমন্বিত পরিকল্পনায় কাজ করতে হবে, যাতে মানুষ শুধু ঘরই নয়- মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তিও ফিরে পায়।