বরেন্দ্র অঞ্চলের তীব্র পানিবৈষম্য এখন আর কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর মানবাধিকার সংকটে পরিণত হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। আজ বুধবার দুপুরে রাজশাহী এসকে সেমিনার হলে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বারসিক) ও গ্রিন কোয়ালিশনের আয়োজনে ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিবৈষম্য ও মানবাধিকার: সংকট, কাঠামো ও করণীয়’ শীর্ষক সংলাপ ও মতবিনিময় সভায় বক্তারা এই জরুরি আহ্বান জানান।
সংলাপের শুরুতে বারসিক-এর নৃবিজ্ঞানী ও আঞ্চলিক সমন্বয়ক মো. শহিদুল ইসলাম তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, পানি শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি জীবন, স্বাস্থ্য, জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং মানবাধিকার রক্ষার মূল উপাদান। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণা (UDHR)-এর ২৫ অনুচ্ছেদ, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তির General Comment No. ১৫ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG-৬) পানিকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানও মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও জীবিকার অধিকারকে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে, যা নিরাপদ পানি ছাড়া অসম্ভব।
বক্তারা জোর দিয়ে বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, গভীর নলকূপের মাধ্যমে কৃষি পানি উত্তোলন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে, এবং ঘন ঘন খরা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে দরিদ্র পরিবারগুলোকে প্রতি লিটার পানির জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে, যা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। পানি না থাকলে জীবনের অধিকারের বাস্তবায়ন অসম্ভব, খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ভেঙে পড়ে এবং স্থানীয় অর্থনীতি টিকে থাকা কঠিন হয়।
মুক্ত আলোচনায় তানোর উপজেলার মন্ডুমালার মাহালী আদিবাসী কৃষাণী চিচিলিয়া হেমব্রম তার কষ্টের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা অনেক দূর থেকে পানি আনি, কোমরে ব্যথা হয়, অনেক সময় পথে ঘাটে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। বাচ্চা যখন এক গ্লাস পানির জন্য হাহাকার করে, তখন সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারি না, বুকটা ভেঙে যায়।’
মহিলা পরিষদের নারী নেত্রী কল্পনা রায়ও বলেন, নারীরাই পানি সংগ্রহে বেশি বৈষম্যের শিকার এবং এর ফলে তাদের নিরাপত্তা সংকটে পড়ছে।
রাজশাহী সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন অভিযোগ করেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা ও নীতি আইনগুলো সবসময় উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে এখানকার জনমানুষের বাস্তব দিকগুলো প্রতিফলিত হয় না।
রুলফাও-এর নির্বাহী পরিচালক মো. আফজাল হোসেন প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংসের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ‘দিনে দিনে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো নষ্ট করা হয়েছে, বিলগুলো ধ্বংস করা হয়েছে পুকুর খনন করে। এর ফলে মানুষের অধিকার আরও সংকুচিত হয়েছে।’
পরিবর্তনের রাশেদ রিপন পানির বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি নিয়ে শুধু ব্যবসা হচ্ছে, পানি কীভাবে বিক্রি করা যায় সে বিষয়ে নীতিমালা তৈরি হয়। জনগণের চাওয়া-পাওয়ার দিক বিবেচনা করা হয় না। তিনি সরকারের একটি গেজেট ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, সরকার হঠাৎ করে ৪ হাজার ৯১১টি মৌজায় কৃষি কাজে সম্পূর্ণরুপে পানি ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, সরকার বিকল্প কিছু সৃষ্টি না করে এভাবে কৃষকের উৎপাদন থামাতে পারে না। এসব অঞ্চলে স্বল্প পানির রবিশস্যের চাষাবাদ করা যেত, সেটাও বন্ধ করা হলো।
গ্রিন কোয়ালিশনের সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ও কৃষি নিয়ে পরিকল্পনা করতে হলে এখানকার প্রবীণ এবং অভিজ্ঞদের সাথে বসতে হবে, হুটহাট পরিকল্পনা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অভিজিৎ তাঁর গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, পানির সাথে জীবন, সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতিও জড়িত। তিনি মনে করেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিবৈষম্য কমাতে এই অঞ্চলের মানুষের সাথে বসে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংলাপ ও মতবিনিময়ে আরও উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মোসা. সামসুর নাহার, রাজশাহী ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ জিল্লুর রহমান, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল, ইয়্যাস-এর সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, সমাজকল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সম্রাট রায়হান এবং ওয়াটার ইয়ুথ পার্লামেন্টের জুলফিকার আলী হায়দার প্রমুখ ।


