ঢাকারবিবার , ১৮ মে ২০২৫

বিশ্বে আম উৎপাদনে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে অষ্টম বাংলাদেশ

রঞ্জন কুমার দে
মে ১৮, ২০২৫ ২:৫৭ অপরাহ্ণ । ৬৮৩ জন

গ্রীষ্মকাল মানেই আমের রাজত্ব। পৃথিবীর বহু দেশে আম শুধু একটি ফল নয়, বরং একটি আবেগ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আম উৎপাদন ও রপ্তানি একটি বড় খাত হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এই উৎপাদনের ক্ষেত্রে সকল দেশ সমান নয়। সম্প্রতি World Population Review প্রকাশিত ২০২২ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি আম উৎপাদনকারী দেশের তালিকা আমাদের চোখে আনে একটি বৈচিত্র্যময় বাস্তবতা—যেখানে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার দেশগুলো এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এ প্রতিবেদন সেই তালিকাভুক্ত দেশগুলোর উৎপাদন পরিমাণ এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরবে।

শীর্ষে রয়েছে ভারত, যার অবস্থান আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে একেবারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ২০২২ সালে ভারত এককভাবে ২৬.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন আম উৎপাদন করেছে, যা দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ার উৎপাদনের প্রায় ছয় গুণেরও বেশি। এই পরিমাণ পৃথিবীর মোট আম উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। ভারতের উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে আম উৎপাদন হয়। ভারতের ‘আলফানসো’, ‘ল্যাংড়া’, ‘দশেরি’ ও ‘হিমসাগর’ প্রভৃতি জাত বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। আম এখানে শুধু খাওয়ার ফল নয়, এটি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, রপ্তানি, স্থানীয় বাজার এবং কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, যার উৎপাদন ছিল ৪.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ইন্দোনেশিয়ায় আম উৎপাদন মূলত জাভা, সুমাত্রা ও বালির উষ্ণ আবহাওয়ায় হয়ে থাকে। এখানকার জনপ্রিয় জাতগুলোর মধ্যে ‘Gedong Gincu’ এবং ‘Arumanis’ রয়েছে। যদিও ইন্দোনেশিয়ার উৎপাদনের অধিকাংশই স্থানীয় বাজারে ব্যবহৃত হয়, তবে আন্তর্জাতিক বাজারেও কিছু অংশ রপ্তানি করা হয়ে থাকে।

তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীন, যার উৎপাদন ৩.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। দক্ষিণ চীনের গুইঝো, গুয়াংসি ও হাইনান প্রদেশে আম উৎপাদন হয়। চীনে আমের জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং সরকার এই ফলের উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যদিও তাদের উৎপাদন বিশ্বে তৃতীয়, তবুও রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন এখনও বড় ভূমিকা রাখে না, বরং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই এ উৎপাদনের বেশিরভাগ ব্যবহৃত হয়।

পাকিস্তান তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে, যার ২০২২ সালের উৎপাদন ছিল ২.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশ আম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। ‘চৌসা’, ‘সিন্ধরি’, ‘আনোয়ার রতোল’ প্রভৃতি জাত আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ জনপ্রিয়। পাকিস্তান ভারত ও মেক্সিকোর পর তৃতীয় বৃহত্তম আম রপ্তানিকারক দেশ। আম এখানে শুধু অর্থনীতিরই নয়, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো, যাদের উৎপাদন ছিল ২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মেক্সিকো বিশ্বের অন্যতম প্রধান আম রপ্তানিকারক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের ‘Ataulfo’, ‘Kent’, ‘Tommy Atkins’ জাতের আম ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশটির উৎপাদন কাঠামো অনেকটাই রপ্তানি নির্ভর এবং তারা কৃষি আধুনিকীকরণের মাধ্যমে আমের গুণগত মান বজায় রাখছে।

ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে ব্রাজিল, যেখানে ২০২২ সালে আম উৎপাদন হয়েছে ২.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাহিয়া ও পার্নাম্বুকো রাজ্যে এই ফলের উৎপাদন হয়। যদিও ব্রাজিল মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়, তবুও তারা ইউরোপীয় বাজারে কিছু আম রপ্তানিও করে থাকে।

সপ্তম ও অষ্টম স্থানে যথাক্রমে রয়েছে মালাওই এবং বাংলাদেশ। মালাওই আফ্রিকার দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি দেশ, যেখানে ১.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে। আফ্রিকান জলবায়ু ও উর্বর মাটি এই উৎপাদনে সহায়ক। মালাওইর কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে আম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং স্থানীয় বাজার ছাড়াও আঞ্চলিক বাজারেও এর চাহিদা আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০২২ সালে ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। দেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ ও সাতক্ষীরা জেলাগুলোতে আমের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। বাংলাদেশের আমের মধ্যে ‘হিমসাগর’, ‘ল্যাংড়া’, ‘আম্রপালি’, ‘ফজলি’ এবং ‘গোপালভোগ’ জাতগুলো উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে আম উৎপাদন প্রধানত অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য হলেও সম্প্রতি রপ্তানিতে আগ্রহ বাড়ছে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের চেষ্টা চলছে।

নবম ও দশম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড, উভয় দেশের উৎপাদন ছিল ১.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড উভয় দেশেই আম একটি জনপ্রিয় ফল এবং খাদ্য শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। তাদের আম অনেক সময় প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা হয়, যেমন আমের রস, শুকনো আম বা সংরক্ষিত আম হিসেবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে তাদের একটি স্থায়ী অবস্থান রয়েছে।

এই তালিকা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট হয়, তা হলো—গ্রীষ্মপ্রধান ও উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ুসম্পন্ন দেশগুলোই মূলত আম উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। এছাড়াও, কৃষি অবকাঠামো, সরকারি সহযোগিতা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রপ্তানি বাজারে প্রবেশের দক্ষতা একটি দেশের আম উৎপাদনের পরিমাণ ও মান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।

বিশ্বজুড়ে আমের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের মধ্যে আমের পুষ্টিগুণ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। এতে করে শুধু উৎপাদন নয়, রপ্তানির দিকেও নজর বাড়াতে হবে উৎপাদক দেশগুলোকে। উন্নত মানের সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি কৌশল তৈরি করে তারা বৈশ্বিক বাজারে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, আম উৎপাদন শুধু কৃষি খাতের একটি উপখাত নয়, বরং এটি একটি দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও খাদ্য নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উপরের তালিকাটি সেই বাস্তবতা তুলে ধরে এবং ভবিষ্যতে কৃষি নীতিনির্ধারণে এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।