দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় আটকে থাকার পর ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনটির সংশোধনী অধ্যাদেশ আকারে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ এবং টেলিকমিউনিকেশন অধ্যাদেশ অনুমোদিত হয়।
রীতি অনুযায়ী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদিত সিদ্ধান্তগুলো গণমাধ্যমকে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানিয়ে থাকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখেও যথারীতি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। প্রেস সেক্রেটারি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো পরিস্থিতিতেই ইন্টারনেট বন্ধ রাখা যাবে না—এমন বিধান রেখে টেলিকমিউনিকেশন অধ্যাদেশের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’ এছাড়া অন্য কোনো আইনের সংশোধনী অধ্যাদেশ আকারে অনুমোদনের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
অথচ ২৪ ডিসেম্বরের উপদেষ্টা পরিষদের ওই বৈঠকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশটিও অনুমোদিত হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়। এমনকি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রেস উইং জানায়, শুধু টেলিকমিউনিকেশন অধ্যাদেশই অনুমোদিত হয়েছে। পরে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও একটি অধ্যাদেশ অনুমোদনের কথাই উল্লেখ করা হয়। কেন একটি সরকারি জনগুরুত্বপূর্ণ তামাক নিয়ন্ত্রণ সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুমোদনের তথ্য গোপন করা হলো, তা রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ।
সবচেয়ে বড় কথা, গেল দেড় বছরে অন্তর্বর্তী সরকার অর্ধশতাধিক আইনের সংশোধনী অনুমোদন দিয়েছে। অথচ শুধুমাত্র ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংশোধনীর বিষয়ে পর্যালোচনার কমিটি করা হয় এবং সেই কমিটি এক বছর ধরে পর্যালোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে। কেন ও কাদের স্বার্থে তথাকথিত পর্যালোচনার জন্য একটা বছর দেরি করলো অন্তর্বর্তী সরকার, সেই প্রশ্নের নেই উত্তর। তবে এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, অতীতের মতো বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারকদের সাথেও তামাক কোম্পানির লবিস্টদের তদবিরের সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে। সেই কারণে আইনের সংশোধন ঠেকাতে তারা দেরি করানোর অংশ হিসেবেই তথাকথিত পর্যালোচনার কথা বলে সময় নষ্ট করেছে।
ভুল নয়, পরিকল্পিতভাবেই সরকার তথ্য গোপন করেছে
দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণকর্মীদের অভিযোগ, এটি ভুলে নয়, পরিকল্পিতভাবেই তামাক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার অংশ হিসেবে অনুমোদিত দুটি অধ্যাদেশের মধ্যে একটি সম্পর্কে তথ্য জানায়নি প্রেস উইং। তাদের অভিযোগ, তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের কারণে পর্যবেক্ষণের নামে এক বছর ধরে আটকে রাখার ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর খবরটি চেপে গেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
দীর্ঘ সময় নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে যখন উপদেষ্টা পরিষদ তামাক নিয়ন্ত্রণের সংশোধনী অধ্যাদেশটি অনুমোদন করেছে, তখনও তামাক কোম্পানির ধারাবাহিক হস্তক্ষেপের অংশ হিসেবেই এই অধ্যাদেশটি সম্পর্কে টুঁ শব্দ করা হয়নি। অভিযোগ আছে, উপদেষ্টা পরিষদের দু–একজন উপদেষ্টার আগ্রহের কারণেই তামাক নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশটির তথ্য গোপন করা হয়েছে। তাদের নির্দেশনার ফলেই বৈঠক-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে প্রেস উইং।
কেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যাদেশটির তথ্য চেপে রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। অথচ তথ্য গোপন করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। মজার ব্যাপার হলো, অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে যে, স্বাধীন সাংবাদিকতার স্বার্থে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। তাহলে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হলো কেন?
বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হওয়ায় ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখেই আলাদা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুমোদনের বিষয়টি তুলে ধরে লাইন মন্ত্রণালয়। তাদের সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেই সাংবাদিক, তামাক নিয়ন্ত্রণকর্মীসহ দেশের মানুষ বিষয়টি জানতে পারে।
নতুন সংশোধনীতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধনী) অধ্যাদেশে মোটা দাগে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। যা তামাক কোম্পানির জন্য সুখকর নয়।
প্রথমত: সিগারেটের প্যাকেটের উভয় পাশে ৭৫ শতাংশ জায়গাজুড়ে ছবিযুক্ত সতর্কবাণী ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। বর্তমানে প্যাকেটের ওপরের অংশে ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে গ্রাফিক হেলথ ওয়ার্নিং দেওয়ার বিধান থাকলেও তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে প্রায় এক দশক ধরে তা লঙ্ঘিত হয়ে আসছে। খোঁড়া অজুহাতে সিগারেট কোম্পানিগুলো আইন-বিধি অনুযায়ী প্যাকেটের ওপরের অংশে না দিয়ে নিচের দিকে সতর্কবাণী ছাপিয়ে আসছে। এখন ৭৫ শতাংশ জায়গাজুড়ে সতর্কবাণী ব্যবহারের সিদ্ধান্ত অনুমোদনের পরও উপদেষ্টাদের কেউ কেউ তা মেনে নিতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে তামাক নিয়ন্ত্রণকর্মীদের।
দ্বিতীয়ত: বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল, ই-সিগারেট ও ভ্যাপের পাশাপাশি নতুন তামাকজাত পণ্য নিকোটিন স্পাউচকে ‘তামাকজাত দ্রব্য’-এর সংজ্ঞার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ উপেক্ষা করে সম্প্রতি নিকোটিন স্পাউচ কারখানার ছাড়পত্র দিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। অথচ ২০১৬ সালের ১ মার্চ উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের ফুলকোর্ট বেঞ্চের রায়ে দেশে নতুন কোনো তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার অনুমোদন না দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। এই নির্দেশনার পরও ২০১৮ সালে জাপান টোব্যাকোকে বাংলাদেশে ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয় এবং বর্তমানে ফিলিপ মরিসকে নিকোটিন স্পাউচ কারখানা স্থাপনের ছাড়পত্র দিয়েছে বিডা ও বেজা কর্তৃপক্ষ। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে স্পষ্ট আপত্তি জানিয়ে অনুমতি বাতিলের জন্য চিঠি দিয়েছে।
এমনিতেই বিশ্বে সিগারেট উৎপাদনে বাংলাদেশ অষ্টম এবং তামাক চাষে দ্বাদশ স্থানে রয়েছে। নতুন করে নিকোটিন স্পাউচ কারখানা স্থাপন তরুণদের আরও বেশি আসক্ত করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
কারণ ছোট ট্যাবলেট আকারের ভয়ংকর নেশাজাতীয় পণ্য ‘ইয়াবা’ খুব দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী ইয়াবার নেশায় বুঁদ হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছে ইয়াবা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নতুন তামাকজাত পণ্য নিকোটিন স্পাউচও তেমনি বিপজ্জনক হতে পারে বাংলাদেশে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা বেচাকেনা হয়। ইয়াবাসহ অন্যান্য নেশাজাতীয় পণ্যের বাজার ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৩ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ জনমিতিক সুফল বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পাচ্ছে। ফলে এই তরুণদের সিগারেট-নিকোটিন স্পাউচসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য থেকে ফেরাতে না পারলে ২০৪৫ সালে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বিফলে যাবে। আর সব নেশার শুরু সিগারেট দিয়ে—সিগারেটই মাদকের গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে। তাই নিকোটিন স্পাউচে তরুণদের আসক্ত হওয়ার আশঙ্কা বাস্তব।
তৃতীয়ত: সংশোধিত ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে সব ধরনের ই-সিগারেট, ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ENDS) এবং হিটেড টোব্যাকো পণ্য (HTP) আমদানির পাশাপাশি বিপণন ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
চতুর্থত: সব পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানসহ সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখাও সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষ করা হয়েছে। এছাড়াও বিক্রয়স্থল ও ইন্টারনেটসহ সব মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচার ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বৈধভাবে অবৈধ ব্যবসা করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো
বর্তমানে সিগারেট কোম্পানিগুলো মূল্যতালিকার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এমআরপি লঙ্ঘন করছে। যেমন, বেনসন সিগারেটের ২০ শলাকার প্যাকেটের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ৩৭০ টাকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। সেই অনুযায়ী, ক্রেতাদের জন্য প্রতি শলাকা বেনসন সিগারেটের দাম হয় ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ প্রতি শলাকা বেনসন সিগারেটের ২০ টাকায় বিক্রির জন্য সিগারেট কোম্পানিগুলো দোকানে দোকানে বিজ্ঞাপন টানিয়ে রাখে বছরের পর বছর এবং দোকানিদের বাধ্য করছে ২০ টাকায় বিক্রিতে। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত দাম ১৮ টাকা ৫০ পয়সার চেয়ে প্রতি শলাকায় ১ টাকা ৫০ পয়সা বেশি নিচ্ছে। প্যাকেটের দাম ৩৭০ টাকা কিন্তু ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৪০০ টাকায়। প্রতি প্যাকেটে ৩০ টাকা বাড়তি নিচ্ছে। একইভাবে মালবোরো, গোল্ড লিফ, ক্যামেল, লাকি স্ট্রাইকসহ সব ধরনের সিগারেটের এমআরপির চেয়ে শলাকা প্রতি ১ টাকা করে বেশি নিচ্ছে জনগণের কাছ থেকে। সবগুলো কোম্পানি আইন ভঙ্গ করে বেশি দামে সিগারেট বিক্রির জন্য রীতিমতো লাখ লাখ বিজ্ঞাপন টানিয়ে বৈধভাবে অবৈধ ব্যবসা করছে। এনবিআরের হিসাবে বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মোট সিগারেট বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৫৪২ কোটি শলাকা। শলাকা প্রতি ১ টাকা বাড়তি নেওয়ায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ভোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি নিয়েছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। যেখানে গড়ে ৮১ শতাংশ কর হিসাবে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু এমআরপি লঙ্ঘন করার পাশাপাশি কর ফাঁকি দিয়ে আসছে কোম্পানিগুলো। শুধু প্রিমিয়াম স্তরে নয়, সব ধরনের সিগারেটেই কূটকৌশলে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিগারেট কোম্পানি।
কূটকৌশলে তামাক কোম্পানিগুলো শুধু কর ফাঁকি দিচ্ছে না, তারা নীতি নির্ধারণেও হস্তক্ষেপ করছে। এক বছর ধরে আইন সংশোধনী আটকে রাখা তারই প্রমাণ।
দেরিতে হলেও জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থের বিবেচনায় অধ্যাদেশটি অনুমোদনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ। তবে তথ্য গোপনের চেষ্টা গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। অতীতে আমরা দেখেছি, আইন পাসের পর বিধি তৈরির নামে বছরের পর বছর ফাইল আটকে রাখা হয়েছে। প্রেস উইংয়ের রহস্যজনক নীরবতা সেই পুরোনো আশঙ্কাই আবার উসকে দেয়-এই অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশ ও বাস্তবায়নে যেন দেরি না হয়।
তামাক নিয়ন্ত্রণকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উপেক্ষিত
তামাক নিয়ন্ত্রণকর্মীরা আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ এবং দোকানিদের লাইসেন্সের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি প্রস্তাব গ্রহণ করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। খুচরা শলাকা সিগারেট বিক্রির মাধ্যমে কীভাবে বছরে জনগণের কাছ থেকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলো—সে আলোচনা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এখন আসা যাক সিগারেট বিক্রেতাদের লাইসেন্স বা নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে। মোটা দাগে সিগারেট বিক্রেতাদের লাইসেন্স থাকলে বিক্রেতা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সরকার—এই তিন পক্ষই উপকৃত হতো। কারণ বর্তমানে সারা দেশে টং দোকানসহ সিগারেট বিক্রেতাদের কোনো নিবন্ধন নেই। যদি নামমাত্র বছরে ৩০০ টাকা নিবন্ধন ফি দিয়ে তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনা যেত, তাহলে দোকানি সহ দেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতো।
সিগারেট বিক্রেতাদের লাইসেন্স থাকলে তিন সুবিধা
এক: খুচরা দোকানিদের সরকারি নিবন্ধন থাকলে তারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পেত এবং দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের সময়ে সরকারের বিভিন্ন সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। ইতিপূর্বে রাজনৈতিক সহিংসতায় ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিবন্ধন বা কোনো পরিচয়পত্র না থাকায় সড়কের পাশে এসব ক্ষুদ্র দোকানিরা কোনো সহায়তা পায়নি।
দুই: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই ডাটাবেস ব্যবহার করে বাজারে অবৈধ বিদেশি সিগারেট বিক্রি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারত। দোকানিদের মোবাইল নম্বরে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে এনবিআর তাদের সচেতন ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে পারত। এতে যতটুকু বিদেশি সিগারেট বিক্রি হচ্ছে, তা বন্ধে দারুণ সহায়ক হতো। কিন্তু সেটি তামাক কোম্পানির পছন্দ নয়, কারণ চোরাচালানের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে সিগারেট কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্টতার বহু নজির রয়েছে। তাই তারা লাইসেন্সের আওতায় আনা হলে দোকানিরা পথে বসবে—এই জুজু দেখিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বিভ্রান্ত করেছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো দোকানিদের স্বার্থে নয়, বরং নিজেদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবসার স্বার্থেই লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
তিন: পান,বিড়ি,সিগারেট,চা–বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে লাইসেন্স বা নিবন্ধন ফি পেলে স্থানীয় সরকারের রাজস্ব আয় সামান্য হলেও বাড়ত। বছরে ৩০০ টাকা মানে দিনে এক টাকারও কম সরকারকে দিতে হবে। আর দিনে এক টাকা দিলে নিশ্চয় কোনো দোকানির ব্যবসা বন্ধ যাবে না, যাওয়ার কথা নয়! অথচ ক্ষুদ্র দোকানিদের ব্যবসা হারানোর ভয় দেখিয়ে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো সরকারকে বিভ্রান্ত করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, সিগারেটের চোরাচালান ও অবৈধ সিগারেট বন্ধে কার্যকর এই ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ ব্যবহার করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যদি পর্যটকদের নিবন্ধন করে যেতে হয়, তাহলে দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনাকারী দোকানিদের নিবন্ধন নেওয়া কি অযৌক্তিক? মোবাইল সিম কিনতেও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। তাহলে যত্রতত্র দোকান পরিচালনার ক্ষেত্রে নিবন্ধনের সমস্যা কোথায়? আসলে ভূতটা সর্ষের মধ্যেই রয়েছে। চোরাচালানের কারণে রাজস্ব হারানোর ভয় দেখালেও সিগারেট কোম্পানিগুলো আসলে চোরাচালান বন্ধ করতে চায় না।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখা ভালো, সারা দেশে লাখ লাখ মামলা ঝুলছে আদালতে। যেখানে অসংখ্য মামলায় শত শত অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। এতে সাধারণ দোকানিসহ যে কাউকে এসব মামলায় আসামি করে হয়রানির ঝুঁকি থাকে। তাই স্থানীয় প্রশাসনে নিবন্ধিত থাকলে চা–সিগারেট বিক্রেতাদের পরিচয় সরকারের নথিতে থাকত এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করার সুযোগ সীমিত হতো। কিন্তু এসব বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে তামাক কোম্পানির ভয় দেখানো যুক্তিতেই বিশ্বাস করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
তারপরও দেরিতে হলেও ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধনী) অধ্যাদেশ অনুমোদন করায় অন্তর্বর্তী সরকারকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে প্রত্যাশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে অধ্যাদেশটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। কারণ গেজেট না হওয়ায় অধ্যাদেশটিতে কী কী পরিবর্তন এসেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ সবার আগে!
লেখক: সুশান্ত সিনহা, সাংবাদিক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক


