ঢাকাসোমবার , ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
  • অন্যান্য

সতর্কতা ছাড়া ‘সবুজ’ উদ্যোগও কেন হয়ে উঠছে বৈশ্বিক ক্ষতির উৎস

নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিসেম্বর ১৫, ২০২৫ ২:০১ অপরাহ্ণ । ৪৭ জন

পরিবেশ রক্ষার আহ্বান আজ বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে। পুনঃব্যবহার, মেরামত ও সচেতন ভোগকে উপস্থাপন করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ রক্ষার নৈতিক পথ হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়- এই তথাকথিত ‘সবুজ’ উদ্যোগ কি সত্যিই সবার জন্য সমানভাবে টেকসই, নাকি তা নতুন এক বৈশ্বিক অন্যায়কে স্বাভাবিক করে তুলছে? বাস্তব চিত্র বলছে, কাঠামোগত সংস্কার ও কঠোর জবাবদিহি ছাড়া টেকসইতার প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশ রক্ষার বদলে বৈশ্বিক অসমতা আরও গভীর করছে।

ফ্যাশন শিল্পের দিকেই তাকালে এই দ্বন্দ্ব সবচেয়ে স্পষ্ট হয়। বিশ্বব্যাপী এই শিল্প প্রতি বছর প্রায় ৯২ মিলিয়ন টন টেক্সটাইল বর্জ্য উৎপাদন করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান উৎপাদন ও ভোগের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে ১৩৪ মিলিয়ন টনে পৌঁছাবে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ব্যবহৃত পোশাক সংগ্রহ করা হলেও সেগুলোর বড় অংশ স্থানীয়ভাবে পুনঃব্যবহার হয় না। বরং এসব পোশাকের প্রায় ৭০ শতাংশ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।

ঘানার রাজধানী আক্রা এই বৈশ্বিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেখানে প্রতি সপ্তাহে আনুমানিক ১৫ মিলিয়ন ব্যবহৃত পোশাক প্রবেশ করে। বাস্তবে এসব পোশাকের একটি বড় অংশ বাজারে বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং গবেষণা অনুযায়ী প্রায় ৪০ শতাংশ পোশাক শেষ পর্যন্ত সরাসরি বর্জ্যে পরিণত হয়। এই পোশাকগুলো স্থানীয় ল্যান্ডফিল, নালা-নর্দমা ও জলপথে জমে পরিবেশ দূষণ বাড়ায় এবং ধীরে ধীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপ নেয়, যা মাটি, পানি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

এই ব্যবস্থার সামাজিক মূল্য আরও গভীর। একসময় আফ্রিকার বহু দেশে শক্তিশালী টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প ছিল। শুধু ঘানার কথাই ধরা যাক- ১৯৮০-এর দশকে এই খাতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ কর্মরত ছিলেন। ব্যবহৃত পোশাকের লাগামহীন আমদানি ও নীতিগত উদাসীনতার কারণে বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র প্রায় ২ হাজারে। কেনিয়া, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া ও উগান্ডার মতো দেশগুলোতেও একই রকম পতন দেখা যাচ্ছে, যেখানে স্থানীয় উৎপাদন হারিয়ে যাচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।

অথচ গ্লোবাল নর্থে এই একই পোশাককে ‘ভিনটেজ’ বা ‘সেকেন্ড-হ্যান্ড’ নামে নৈতিক ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। ডেপপ, ভিন্টেডসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এসব পোশাক প্রিমিয়াম দামে বিক্রি হয়, যা ক্রেতাদের পরিবেশ-সচেতনতার একটি ইতিবাচক অনুভূতি দেয়। বাস্তবে কিন্তু গ্লোবাল সাউথের কান্তামান্তো মার্কেটের মতো জায়গায় হাজার হাজার শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে দিনরাত পোশাক বাছাই ও মেরামতের কাজ করেন। তাদের বেশিরভাগেরই নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি কিংবা সামাজিক সুরক্ষা।

ইলেকট্রনিক্স খাতেও একই ধরনের বৈপরীত্য স্পষ্ট। সংস্কারকৃত স্মার্টফোন ও ডিভাইসকে পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে তুলে ধরা হলেও, বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে কেবল বাইরের কাঠামো পুনঃব্যবহার করা হয়। ভেতরের ব্যাটারি, চিপ ও স্ক্রিন নতুন হওয়ায় খনিজ উত্তোলন ও ই-বর্জ্যের সংকট থেকেই যায়। বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির জন্য ব্যবহৃত কোবাল্টের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো থেকে, যেখানে খনি শ্রমিকদের মানবাধিকার ঝুঁকি ও পরিবেশগত ক্ষতি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়।

এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে, শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতা বা ভোগের ধরন বদলেই বৈশ্বিক পরিবেশ সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। পুনঃব্যবহার ও মিতব্যয়ী জীবনধারা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এগুলোকে যদি কাঠামোগত সংস্কারের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তবে তা সমস্যার মূল উৎসকে আড়াল করে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যখন অতিরিক্ত উৎপাদন অব্যাহত রাখে এবং সরকারগুলো যখন বর্জ্য রপ্তানি, শ্রম অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপে ব্যর্থ হয়, তখন ‘সবুজ’ উদ্যোগ কার্যত একটি নৈতিক মুখোশে পরিণত হয়।

প্রকৃত টেকসইতা মানে শুধু কম ভোগ করা নয়; এর অর্থ দায়িত্বের ন্যায্য বণ্টন। যেখানে বর্জ্য তৈরি হয়, সেখানেই তার ব্যবস্থাপনার দায় নিতে হবে। যেখানে পণ্য বিক্রি হয়, সেখানেই তার পরিবেশগত ও সামাজিক মূল্য পরিশোধ করতে হবে। ৯২ মিলিয়ন টন থেকে ১৩৪ মিলিয়ন টনে বর্জ্য বৃদ্ধির পূর্বাভাস, ৭০ শতাংশ পোশাক রপ্তানি, ১৫ মিলিয়ন পোশাকের সাপ্তাহিক প্রবাহ, কিংবা ৩০ হাজার থেকে ২ হাজারে নেমে আসা কর্মসংস্থান- এই সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি বৈশ্বিক অন্যায়ের প্রমাণ।

তথ্যসুত্র: আর্থ ডট ওআরজি