মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ইরান ও ইসরায়েল দুটি বিপরীত মেরুর দেশ। দীর্ঘদিন ধরেই এই দুই রাষ্ট্র পরোক্ষ সংঘাতে লিপ্ত, কখনো তা সরাসরি সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে, আবার কখনো তা ছায়াযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে, তাদের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা বেড়ে গেছে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা কেমন, তাদের শক্তি ও দুর্বলতা কোথায়, তা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
জনশক্তি ও সামরিক জনবল বিচারে ইরান একটি বিশাল শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রায় ৮৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটির সক্রিয় সামরিক বাহিনীতে রয়েছেন প্রায় ছয় লক্ষ সেনা সদস্য, যার মধ্যে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী ছাড়াও রয়েছে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)। IRGC নিজস্ব কমান্ড কাঠামো এবং আলাদা অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে পরিচালিত একটি সমান্তরাল বাহিনী। এই বাহিনীর অধীনে রয়েছে ‘Quds Force’ নামে বিশেষায়িত বাহিনী যারা মধ্যপ্রাচ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ, ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। অন্যদিকে, ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯.৫ মিলিয়নের মতো হলেও, দেশটির সক্রিয় বাহিনীতে প্রায় ১.৭ লক্ষ সেনা এবং রিজার্ভে রয়েছে ৪.৫ লক্ষের মতো সদস্য। ইসরায়েলের সামরিক কাঠামো একটি ‘প্রতিরক্ষা বাধ্যতামূলক নিয়োগভিত্তিক ব্যবস্থা’র ওপর গঠিত, যেখানে পুরুষদের তিন বছর এবং নারীদের দুই বছর সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই কারণে তাদের রিজার্ভ বাহিনীও অত্যন্ত প্রশিক্ষিত এবং দ্রুত সক্রিয় হতে সক্ষম।
বিমানবাহিনী হলো ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই বাহিনীর কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-৩৫আই ‘Adir’, যার মাধ্যমে তারা শত্রু দেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম। ইসরায়েলের বিমানবাহিনীতে রয়েছে প্রায় ৩৯টি এফ-৩৫, ১৯৬টি এফ-১৬, এবং ৭৫টি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান। প্রতিটি বিমানে রয়েছে উন্নত অস্ত্রনির্দেশনা প্রযুক্তি এবং সেন্সর। ইসরায়েল নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তাদের বিমানবহরকে আপডেট করে থাকে। অপরদিকে, ইরানের বিমানবাহিনী তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ নির্ভর। তাদের যুদ্ধবিমানের বেশিরভাগই ১৯৭০ ও ১৯৮০ সালের পুরাতন মডেলের যেমন F-4 Phantom, F-5 Tiger, এবং F-14 Tomcat। কিছু MiG-29 এবং Su-24 রয়েছে, তবে সেগুলোর আধুনিকীকরণ সীমিত। ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে কিছু প্রশিক্ষণ ও হালকা যুদ্ধবিমান উৎপাদন করেছে, তবে সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে বিমানক্ষেত্রে ইসরায়েলের একচেটিয়া আধিপত্য বিদ্যমান।
নৌবাহিনী প্রসঙ্গে, ইরান কৌশলগতভাবে পারস্য উপসাগর, হরমুজ প্রণালী ও ওমান উপসাগরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাদের নৌবাহিনীর দুটি ধারা রয়েছে—প্রথাগত নৌবাহিনী এবং IRGC নৌবাহিনী। IRGC-র নৌবাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট, তবে অসংখ্য ক্ষুদ্র দ্রুতগামী বোট, মাইন এবং ড্রোন বহনক্ষম জাহাজ দিয়ে সুসজ্জিত। সম্প্রতি ইরান প্রথমবারের মতো একটি ড্রোন ক্যারিয়ার ‘শহীদ বাগেরি’ নামে চালু করেছে, যা একাধিক যুদ্ধড্রোন বহনে সক্ষম। এছাড়া ইরানের Ghadir ও Fateh-শ্রেণির সাবমেরিন রয়েছে, যারা ক্ষেপণাস্ত্র ও টর্পেডো বহন করতে পারে। অন্যদিকে ইসরায়েলের নৌবাহিনী অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও তারা অত্যাধুনিক ডলফিন-শ্রেণির সাবমেরিনে সজ্জিত, যেগুলোতে পরমাণু অস্ত্র বহনের ক্ষমতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এগুলো মূলত ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন থাকে এবং ইসরায়েলের দ্বিতীয় আঘাতক্ষমতা (second-strike capability) নিশ্চিত করে।
ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন প্রযুক্তিতে ইরান গত এক দশকে বিস্ময়কর অগ্রগতি করেছে। তাদের নিজস্বভাবে তৈরি ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলোর মধ্যে রয়েছে শেহাব-৩, ঘাদর, খোররামশাহর এবং এমারাদ, যেগুলোর রেঞ্জ ৫০০ থেকে ২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ইরান এমনকি Paveh নামের একটি ক্রুজ মিসাইল তৈরি করেছে, যার রেঞ্জ ১৬৫০ কিলোমিটার বলে দাবি করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে তারা কাসেম বাসির নামক একটি হাইপারসনিক মিসাইলের পরীক্ষাও করেছে, যার গতি ও লক্ষ্যভেদ ক্ষমতা অত্যন্ত উন্নত বলে দাবি করা হয়েছে। ড্রোন প্রযুক্তিতেও ইরান অনেক দূর এগিয়ে গেছে। শাহেদ-১৩১, ১৩৬, মোহাজের-৬, এবং আবাদিল-৩ ড্রোনগুলি ইউক্রেনে রাশিয়ার মাধ্যমে ব্যবহার হতে দেখা গেছে। এগুলো অপেক্ষাকৃত সস্তা, সহজে উৎপাদনযোগ্য এবং লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে কার্যকর, যদিও সহজে গুলি করে নামানো সম্ভব। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে তাদের ব্যালিস্টিক মিসাইল সীমিত হলেও, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে তারা বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে। ‘আয়রন ডোম’, ‘ডেভিডস স্লিং’, এবং ‘অ্যারো-৩’ নামক তিন স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি অভেদ্য আকাশ প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলেছে। এই প্রযুক্তিগুলোর মাধ্যমে তারা ব্যালিস্টিক মিসাইল, রকেট এবং ড্রোন শনাক্ত করে তা ভূপাতিত করতে পারে। এছাড়া ইসরায়েল JDAM, Spice, Delilah প্রভৃতি গাইডেড মিসাইল এবং স্মার্ট বোমা ব্যবহার করে থাকে।
পারমাণবিক সক্ষমতা ইসরায়েলের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও বিতর্কিত বিষয়। তারা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করেনি, তবে আন্তর্জাতিক পর্যালোচক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করে ইসরায়েলের কাছে ৮০ থেকে ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যা তারা ডলফিন সাবমেরিন, ফাইটার জেট বা ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম। তারা ‘policy of opacity’ বা ‘অস্পষ্টতার নীতি’ অনুসরণ করে থাকে, যার ফলে শত্রুপক্ষ নিশ্চিত হতে পারে না তাদের সুনির্দিষ্ট সক্ষমতা সম্পর্কে। অন্যদিকে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বহু বছর ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ২০১৫ সালের ‘Joint Comprehensive Plan of Action’ (JCPOA) অনুসারে তারা তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করেছিল, তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ইরান আবার তার কর্মসূচি পুনরায় সক্রিয় করেছে। বর্তমানে তারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও তারা এখনো দাবি করে যে তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং বেসামরিক লক্ষ্যেই পরিচালিত।
সাইবার সক্ষমতা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ২০১০ সালে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় স্টাক্সনেট (Stuxnet) নামক ভাইরাস আক্রমণের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সাইবার-ভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হয়, যার পেছনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত থাকার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। এরপর থেকে উভয় দেশই একে অপরের অবকাঠামোতে সাইবার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান ইসরায়েলের জলপ্রকল্প ও ব্যাংকিং সেক্টরে হামলা চালিয়েছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের তেল শোধনাগার, ট্রেন সিস্টেম ও রাসায়নিক কারখানায় ডিজিটাল ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে।
২০২৫ সালে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ইসরায়েল বেশ কয়েকটি বিমান হামলা চালায় ইরানের সেনা ঘাঁটি ও পারমাণবিক স্থাপনায়। এর জবাবে ইরান একযোগে কয়েকশো শাহেদ ড্রোন এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়। যদিও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিরভাগ মিসাইল ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়, তবে কিছু মিসাইল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ থেকেই বোঝা যায়, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট বিদ্যমান এবং একটি সীমিত সংঘর্ষ যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে পারে, তাও অস্বীকার করা যায় না।
পরিশেষে বলা যায়, ইরান ও ইসরায়েল ভিন্ন ভিন্ন সামরিক কৌশল ও শক্তির ওপর নির্ভর করে। ইরান সংখ্যাগত দিক থেকে শক্তিশালী হলেও, ইসরায়েল প্রযুক্তি, সংগঠন এবং প্রতিরক্ষামূলক কৌশলে এগিয়ে। দুই দেশই নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার ও কৌশলগত অবস্থানকে রক্ষণাত্মক এবং নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু বাস্তবতা হলো–তাদের সংঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নয়, বরং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপরও প্রভাব ফেলে। এই কারণেই আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত হবে কূটনৈতিকভাবে মধ্যস্থতা করে এ অঞ্চলের উত্তেজনা প্রশমিত করা।


