যেখানে কাঁঠালের গুদাগুলি (ফল অংশ) সাধারণভাবে খাওয়া হয়, সেখানে বীজগুলি প্রায়শই উপেক্ষিত হয়—যদিও এতে রয়েছে বিশাল পুষ্টিগুণ ও কার্যকর উপাদান। দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় ফল কাঁঠাল (বৈজ্ঞানিক নাম: Artocarpus heterophyllus), যা মোরাসি (Moraceae) পরিবারভুক্ত, তার অনন্য স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য সুপরিচিত। গুদার অংশ জনপ্রিয় খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, বীজের পুষ্টিগুণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের সম্ভাবনা দীর্ঘদিন ধরে অপ্রচলিত রয়ে গেছে। তবে বিশ্বব্যাপী উদ্ভিদ-ভিত্তিক ও কার্যকরী খাদ্যের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁঠালের বীজের গুঁড়ো (flour) এখন একটি মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কাঁঠালের বীজ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফাইবার এবং গুরুত্বপূর্ণ অণুপুষ্টিতে (micronutrients) ভরপুর, যা এটিকে গুঁড়ো উৎপাদনের জন্য একটি চমৎকার উপকরণে পরিণত করে। এ ছাড়া এতে রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফাইটো-কেমিক্যাল বা উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক যৌগ, বিশেষ করে ফেনলিক যৌগ, যা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। বীজে থাকা লিগন্যানস, আইসোফ্ল্যাভোনস ও স্যাপোনিন নামক উপাদানগুলো প্রমাণিতভাবে ক্যানসার প্রতিরোধ, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, প্রদাহ নিবারণ এবং গ্যাস্ট্রিক আলসার নিরাময়ে সহায়ক।
কাঁঠালের বীজে পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বায়োঅ্যাকটিভ উপাদানগুলোর একটি হলো “জ্যাকালিন” নামক একটি প্রোটিন, যা ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। ফলে কাঁঠালের বীজ কেবলমাত্র একটি পুষ্টিকর খাদ্য নয়, বরং এটি একটি সম্ভাব্য ‘নিউট্রাসিউটিকাল’ অর্থাৎ ঔষধি গুণসম্পন্ন খাদ্য উপাদানও। এ ছাড়াও এতে প্রচুর ক্যারোটিনয়েড যেমন ‘অল-ট্রান্স-ক্যারোটিন’ (all-trans-carotene) রয়েছে, যা চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং হৃদরোগ, ক্যানসার, চোখে ছানি এবং বার্ধক্যজনিত চোখের সমস্যার মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
তবে এত গুণ থাকা সত্ত্বেও কাঁঠালের বীজের ব্যবহার এখনো খুব সীমিত। অধিকাংশ সময় উচ্চ আর্দ্রতার কারণে এগুলো ফেলে দেওয়া হয় এবং এর সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কে মানুষ কম জানে। অথচ বীজগুলো সেদ্ধ, ভাজা বা কারি ও কাটলেটে যুক্ত করে প্রথাগতভাবেই খাওয়া যায়। সংরক্ষণযোগ্যতা ও ব্যবহারযোগ্যতা বাড়াতে বীজ শুকিয়ে এবং ভেজে গুঁড়ো তৈরি করা যায়, যা একটি টেকসই ও কার্যকরী খাদ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
শুকনো ও ভাজা কাঁঠালের বীজ দিয়ে তৈরি গুঁড়ো বিভিন্ন ধরনের রান্নায় ব্যবহারযোগ্য। একে এককভাবে বা গমের আটা কিংবা অন্যান্য শস্যের সঙ্গে মিশিয়ে রুটি, ডোশা, প্যানকেক, বিস্কুট, পাউরুটি, কেক এমনকি নুডলস তৈরিতেও ব্যবহার করা যায়। এই গুঁড়ো যুক্ত খাদ্যগুণ বজায় রাখে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে স্বাদ, গঠন ও পুষ্টিগুণ আরও বাড়িয়ে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁঠালের বীজ গুঁড়ো দিয়ে তৈরি খাবার স্বাদ, রং, গন্ধ ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে উচ্চ নম্বর পেয়েছে।
এই গুঁড়ো জটিল কার্বোহাইড্রেট এবং খাদ্যআঁশে সমৃদ্ধ, যা হজমে সহায়তা করে এবং দীর্ঘস্থায়ী শক্তি সরবরাহ করে। ফলে খেলোয়াড় ও মানসিক বা শারীরিক ক্লান্তিতে ভোগা ব্যক্তিদের জন্য এটি উপকারী। এটি উদ্ভিদ-উৎপন্ন প্রোটিনের একটি ভালো উৎস, যা নিরামিষভোজী বা ভেগান খাদ্যাভ্যাসে পেশি পুনর্গঠন ও সামগ্রিক সুস্বাস্থ্যে অবদান রাখে।
চিকিৎসাগত দৃষ্টিকোণ থেকেও কাঁঠালের বীজ গুঁড়োতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিডায়াবেটিক এবং অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ কার্যকারিতা—যা এটি স্বাস্থ্যবিষয়ক ও থেরাপিউটিক খাদ্য তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। বিশেষ করে, এই গুঁড়ো গ্লুটেন-মুক্ত (gluten-free) হওয়ায় যারা গ্লুটেন অসহনশীলতা বা সেলিয়াক রোগে ভুগছেন, তাদের জন্য এটি একটি নিরাপদ ও পুষ্টিকর বিকল্প।
শুধু পুষ্টি নয়, কাঁঠালের বীজ গুঁড়ো পরিবেশবান্ধবও। কারণ এটি কৃষিজ অপচয় কমায়। কাঁঠাল যেমন অনেক ট্রপিক্যাল অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়, তেমনই এর বীজ কাজে লাগিয়ে গুঁড়ো তৈরি করা গেলে তা বাড়তি অর্থনৈতিক মূল্যও যোগ করে। এটি কেবল সম্পদ সাশ্রয় করে না, বরং খাদ্য ব্যবস্থাকে আরও টেকসই ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলে।
সারসংক্ষেপে, কাঁঠালের বীজ গুঁড়ো একটি উপেক্ষিত কিন্তু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় কার্যকরী খাদ্য উপাদান। এর পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং খাদ্য প্রক্রিয়ায় ব্যবহারযোগ্যতা একে আধুনিক স্বাস্থ্য-সচেতন খাদ্যাভ্যাসে অন্তর্ভুক্ত করার আদর্শ উপাদানে পরিণত করেছে।
যথাযথ সচেতনতা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে কাঁঠালের বীজকে একটি অবহেলিত উপজাত থেকে রূপান্তরিত করে ভবিষ্যতের টেকসই ও পুষ্টিকর খাদ্য উপাদানে পরিণত করা সম্ভব।


