ঢাকাসোমবার , ১৪ জুলাই ২০২৫
  • অন্যান্য

২০২৫ সালের বিশ্বের ৩০টি সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি

রঞ্জন কুমার দে
জুলাই ১৪, ২০২৫ ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ । ১০৩১১ জন

ভোরবেলা। মেঘলা আকাশের নিচে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো নেমে আসে যুদ্ধবিমানের শব্দ। যেন কোনো অজানা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিচ্ছে। যুদ্ধ এখন আর শুধু বন্দুক আর কামানের শব্দে সীমাবদ্ধ নয়। এটা কূটনীতি, প্রযুক্তি, এবং আধিপত্যের এক সর্পিল লড়াই, যেখানে প্রতিটি দেশ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সামরিক শক্তিকে কেন্দ্র করে সাজিয়ে তোলে এক দীর্ঘ কৌশলগত পরিকল্পনা।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী নিয়ে Global Firepower ২০২৫ সালে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের বাহুবল নয়—বরং প্রযুক্তি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা বাজেট, জনবল, অস্ত্রভাণ্ডার ও কৌশলগত অবস্থানের উপর ভিত্তি করে তৈরি। চলুন, আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি, এই তালিকার দেশগুলো কীভাবে বিশ্বে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র: একচ্ছত্র আধিপত্যের কৌশল
তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বিশ্বব্যাপী ঘাঁটি, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, নিউক্লিয়ার ট্রায়াড, এবং বিপুল প্রতিরক্ষা বাজেট—সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একাধারে সামরিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত পরাশক্তি। ২০২৫ সালে দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৮৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দ্বিতীয় অবস্থানের চীন ও রাশিয়ার বাজেট মিলেও ছুঁতে পারে না।

বিশ্বজুড়ে ৭৫০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি, অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, স্টেলথ বোম্বার, হাইপারসনিক প্রযুক্তি এবং AI সমর্থিত কমান্ড সিস্টেম যুক্তরাষ্ট্রকে করে তুলেছে এক অনতিক্রম্য প্রতিপক্ষ।

রাশিয়া ও চীন: প্রতিযোগিতা ও প্রত্যাঘাত
রাশিয়া, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও ২০২৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে। ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিরক্ষা শিল্পে সংকট থাকা সত্ত্বেও, রাশিয়ার এক বিশাল ট্যাংক বাহিনী, সর্ববৃহৎ পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার, এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তাদের শক্তি ধরে রেখেছে। ভূমি যুদ্ধের জন্য এখনো রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রস্তুত শক্তি।

চীন, তৃতীয় অবস্থানে থাকা দেশ, তুলনামূলকভাবে বেশি ভারসাম্যপূর্ণ ও উন্নয়নমুখী। PLA (People’s Liberation Army) দ্রুত আধুনিকীকরণ করছে। চীন এখন অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরী, ৫ম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, মহাকাশ প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর ভর করে সামরিক দক্ষতা বাড়াচ্ছে। তবে চীনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার মানবসম্পদ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা শিল্প।

ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া: এশিয়ার উদীয়মান শক্তি
চতুর্থ অবস্থানে থাকা ভারত তার ভৌগোলিক অবস্থান ও পরমাণু শক্তির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ সামরিক কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। ২০২৫ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল প্রায় ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশটির অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে পরমাণু সাবমেরিন, ব্যালিস্টিক মিসাইল, এবং একটি ক্রমবর্ধমান বিমানবাহিনী। HAL Tejas, BrahMos মিসাইল ও DRDO–র উন্নয়ন ভারতকে আত্মনির্ভর সামরিক শক্তিতে পরিণত করছে।

দক্ষিণ কোরিয়া, ৫ম অবস্থানে, তার সীমান্তবর্তী শত্রু উত্তর কোরিয়ার হুমকির কারণে সামরিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়। কৌশলগতভাবে, দক্ষিণ কোরিয়ার হাই-টেক মিলিটারি অবকাঠামো, দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা, এবং মার্কিন সামরিক জোট তাদের শক্তিকে বিশাল মাত্রা দিয়েছে।

ইউরোপীয় শক্তির পুনরুদ্ধার: যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন
যুক্তরাজ্য (৬ষ্ঠ), ফ্রান্স (৭ম), ইতালি (১০ম), জার্মানি (১৪তম), এবং স্পেন (১৭তম)—এই ইউরোপীয় দেশগুলো NATO–এর কেন্দ্রীয় অংশ। যুক্তরাজ্যের আধুনিক বিমানবাহী রণতরী (HMS Queen Elizabeth), ফ্রান্সের পরমাণু সাবমেরিন, জার্মানির লিওপার্ড ট্যাংক—এসব কৌশলগত সম্পদ তাদের সামরিক ক্ষমতাকে তীব্রভাবে কার্যকর রাখছে।

তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বৃদ্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠছে ইউক্রেন যুদ্ধের পর। জার্মানি ২০২৫ সালে তার সামরিক ব্যয় দ্বিগুণ করেছে। স্পেন ও ইতালিও NATO চুক্তির ২% লক্ষ্যপূরণে সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের শক্তি চিত্র
তুরস্ক (৯ম), ইরান (১৬তম), পাকিস্তান (১২তম), ইসরায়েল (১৫তম), মিশর (১৯তম) এবং সৌদি আরব (২৪তম)—এই মুসলিম প্রধান ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশগুলো আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রশ্নে ক্রমাগত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

১. তুরস্ক UAV ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। Bayraktar TB2 বিশ্বব্যাপী আলোচিত।
২. পাকিস্তান, পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে ভারতের পাল্টা ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এটিকে শক্তিশালী করেছে।
৩. ইরান, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন এবং আসিমেট্রিক যুদ্ধকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
৪. ইসরায়েল, প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যন্ত আধুনিক। Iron Dome, Arrow System, এবং AI সমর্থিত যুদ্ধব্যবস্থা তাদের পৃথক করে তোলে।
৫. সৌদি আরব উচ্চ প্রতিরক্ষা ব্যয় এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহকৃত সর্বাধুনিক অস্ত্রের কারণে এক আঞ্চলিক শক্তি হলেও আত্মনির্ভরতা কম।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভুমিকা
জাপান (৮ম), ইন্দোনেশিয়া (১৩তম), তাইওয়ান (২২তম), ভিয়েতনাম (২৩তম), থাইল্যান্ড (২৫তম), সিঙ্গাপুর (২৯তম)—এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো ২০২৫ সালে ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তিতে উঠে এসেছে।

১. জাপান, শান্তিপূর্ণ সংবিধান থাকা সত্ত্বেও আত্মরক্ষা বাহিনীকে আধুনিকীকরণ করছে এবং চীন ও উত্তর কোরিয়াকে মাথায় রেখেই সামরিক জোট শক্তিশালী করছে।
২. তাইওয়ান, চীনের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ ঠেকাতে মার্কিন সহযোগিতায় প্রতিরক্ষা জোরদার করছে।
৩. সিঙ্গাপুর, তার ছোট আয়তনের তুলনায় প্রযুক্তিতে উন্নত এবং কৌশলগতভাবে দক্ষ এক সামরিক শক্তি।

আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা: সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শক্তি
ব্রাজিল (১১তম) ও আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকায় সামরিক ভারসাম্য রক্ষা করে। ব্রাজিল তার সমুদ্রভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও রপ্তানিযোগ্য অস্ত্রশিল্প গড়ে তুলেছে।
আলজেরিয়া (২৬তম) আফ্রিকার শীর্ষ সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। ফরাসি ও রুশ অস্ত্রের উপর নির্ভর করে দেশটি আফ্রিকান অঞ্চলে অন্যতম প্রতিপক্ষ।

ইউক্রেন: যুদ্ধক্ষেত্রেই পুনর্জন্ম
ইউক্রেন, তালিকায় ২০তম, ২০২২ সালে রাশিয়ার হামলার পর থেকে বৈশ্বিক সামরিক সহায়তায় বিপুল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। পশ্চিমা অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, এবং স্থানীয় প্রতিরোধ একে এখন “রিয়েল-টাইম” যুদ্ধ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত করেছে। যদিও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকেও এটি শীর্ষে।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: কৌশল নয়, এখন প্রযুক্তিই মূল হাতিয়ার
২০২৫ সালের সামরিক শক্তির এই তালিকা কেবল অস্ত্রভাণ্ডারের পরিমাণ নয়, বরং টেকনোলজিক্যাল আধুনিকতা, প্রতিরক্ষা শিল্পে আত্মনির্ভরতা, এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে গুরুত্ব দেয়। ড্রোন, সাইবার যুদ্ধ, AI, স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রব্যবস্থা—এসবই ভবিষ্যতের যুদ্ধে নির্ধারণ করবে কারা শক্তিশালী থাকবে।

এখন শুধু কামান নয়, কোডই হয়ে উঠছে যুদ্ধের নতুন ভাষা।

প্রতিযোগিতার রাজনীতি বনাম শান্তির কৌশল
বিশ্বে সামরিক শক্তি যত বাড়ছে, ততই বেড়ে চলেছে এক অদৃশ্য উত্তেজনা। শীতল যুদ্ধের পর যুগ পেরিয়ে এসেও পৃথিবী এখনো অস্ত্রের ছায়ায় বিচরণ করছে। তবে এই প্রতিযোগিতা যদি আত্মরক্ষা ও স্থিতিশীলতার জন্য হয়, তবে তা কার্যকর। কিন্তু যদি আগ্রাসনের মোড় নেয়, তবে সেই যুদ্ধ শুধু সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা ছড়িয়ে পড়বে মানবতার ভেতরে।

এই তালিকা আমাদের শেখায়—শক্তি প্রয়োজন, তবে সেই শক্তির ব্যবহার আরও প্রয়োজনীয়ভাবে মানবিক হতে হবে।