ঢাকাবুধবার , ৬ আগস্ট ২০২৫
  • অন্যান্য

বৈশ্বিক পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অগ্রগতি

রঞ্জন কুমার দে
আগস্ট ৬, ২০২৫ ৩:৪২ অপরাহ্ণ । ১৩৯ জন

এক সময় বিশ্বের অন্যতম দুর্বল পাসপোর্ট হিসেবে বিবেচিত হলেও, এখন তা আর আগের জায়গায় নেই। ধীরে ধীরে উন্নতির পথে হাঁটছে বাংলাদেশের পাসপোর্ট। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি প্রকাশিত হেনলি পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উঠে এসেছে ৯৪তম স্থানে, যা আগের বছরের তুলনায় তিন ধাপ উন্নতি।

গল্পের শুরুটা কয়েক বছর আগের। ২০২১ সাল ছিল বাংলাদেশের পাসপোর্ট ইতিহাসে এক হতাশাজনক বছর। ওই বছরে সূচকের তলানিতে—১০৮তম স্থানে নেমে গিয়েছিল দেশের আন্তর্জাতিক ভ্রমণ সক্ষমতা। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয় এক ধীর, তবে ধারাবাহিক উত্তরণ। ২০২২ সালে অবস্থান দাঁড়ায় ১০৩, ২০২৩-এ হয় ১০১। সর্বশেষ ২০২৪ সালের শুরুতে ছিল ৯৭তম স্থানে। এখন সেই জায়গা থেকে আরও এগিয়ে এসে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ৯৪তম অবস্থানে। এটি দেশের জন্য যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ানো খবর, তেমনি সরকারের কূটনৈতিক উদ্যোগ ও বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটি পরোক্ষ স্বীকৃতি।

এই সূচকে স্থান নির্ধারণ করা হয় কোন দেশের পাসপোর্টধারীরা কতটি দেশে ভিসা ছাড়া বা অন-অ্যারাইভাল সুবিধায় প্রবেশ করতে পারেন, সেই হিসাবের ওপর ভিত্তি করে। ২০২৫ সালের সর্বশেষ তালিকায় বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা এখন ৩৯টি দেশে ভিসামুক্ত বা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা পান। এদের মধ্যে রয়েছে বাহামা, বার্বাডোস, ভূটান, বলিভিয়া, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়া, কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ, কোমোরোস, কুক দ্বীপপুঞ্জ, জিবুতি, ডোমিনিকা, ফিজি, গ্রেনাডা, গিনি-বিসাউ, হাইতি, জ্যামাইকা, কেনিয়া, কিরিবাতি, মাদাগাস্কার, মালদ্বীপ, মাইক্রোনেশিয়া, মন্টসেরাট, মোজাম্বিক, নেপাল, নিয়ুয়ে, রুয়ান্ডা, সামোয়া, সেশেলস, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, শ্রীলঙ্কা, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডিনস, দ্য গাম্বিয়া, তিমোর-লেস্তে, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, তুভালু এবং ভানুয়াতু।

এখন যদি বৈশ্বিক চিত্রের দিকে তাকানো হয়, তাহলে দেখা যায়—বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট হিসেবে অবস্থান করছে সিঙ্গাপুর। দেশটির নাগরিকরা এখন ১৯৩টি দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া, দুই দেশের নাগরিকদের ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে ১৯০টি দেশে। এরপর তৃতীয় স্থানে একসঙ্গে রয়েছে সাতটি ইউরোপীয় দেশ—ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি এবং স্পেন, যাদের নাগরিকরা ১৮৯টি দেশে ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন।

অপরদিকে সূচকের সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে আফগানিস্তান। দেশটির পাসপোর্টধারীরা কেবলমাত্র ২৫টি দেশে ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন। অর্থাৎ, শীর্ষ ও নিম্নস্থানে থাকা পাসপোর্টের মধ্যে রয়েছে ১৬৮টি দেশের প্রবেশাধিকারের ফারাক, যা বৈশ্বিক গতিশীলতা ও অসম বৈশ্বিক নাগরিক অধিকার বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

বিষয়টি এখানেই থেমে নেই। এই তালিকা শুধু আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ক্ষমতা নয়, বরং একটি দেশের কূটনৈতিক প্রভাব, বৈশ্বিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা-পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে একসময় পিছিয়ে থাকলেও এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, আর এই উন্নয়ন তারই এক বাস্তব প্রতিফলন।

এবার আসা যাক অন্যান্য দেশের দিকে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ভারত সবচেয়ে বড় উন্নতি করেছে। দেশটি আট ধাপ এগিয়ে ৮৫তম স্থান থেকে উঠে এসেছে ৭৭তম স্থানে, যদিও দেশটি মাত্র দুইটি নতুন দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে (মোট ৫৯টি দেশে)। অন্যদিকে, সৌদি আরব ভিসামুক্ত ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি করেছে। তারা চারটি নতুন দেশ যুক্ত করেছে, যার ফলে মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১ এবং সূচকে অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৫৪তম।

অবনমনের দিকেও চোখ রাখতে হয়। গত এক দশকে বিশ্বের প্রায় সব দেশের পাসপোর্টই কিছু না কিছু উন্নতি করেছে, তবে ১৬টি দেশের পাসপোর্ট র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়েছে। সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে ভেনেজুয়েলার, দেশটি ৩০তম স্থান থেকে নেমে এসেছে ৪৫তম স্থানে। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (৮ ধাপ পতন), ভানুয়াতু (৬ ধাপ), যুক্তরাজ্য (৫ ধাপ) এবং কানাডা (৪ ধাপ)। উল্লেখযোগ্যভাবে, যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রথমবারের মতো ‘টপ ১০’ তালিকা থেকে বাদ পড়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। বর্তমানে দেশটির নাগরিকরা ১৮২টি দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারেন, যা ২০১৪ সালে তাদের প্রথম স্থান অর্জনের সময়কার সংখ্যা থেকে অনেকটাই কম।

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এই অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক হলেও, ভিসামুক্ত দেশের তালিকা এখনো অপেক্ষাকৃত ছোট। এতে করে বিশ্ব ভ্রমণের ক্ষেত্রে এখনও নানা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর অধিকাংশেই বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের আগাম ভিসা প্রয়োজন হয়। ফলে উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা বা পর্যটনের মতো প্রয়োজনেও অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়।

তবে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বিশ্ব পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন স্পষ্ট। বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্বিপাক্ষিক ভ্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে কিছু নতুন দরজা খুলেছে। একই সঙ্গে বৈধ অভিবাসন, বিদেশে কর্মসংস্থান ও বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই রকম প্রবেশাধিকারের পরিসর বাড়ানো সরকারের নীতিগত উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে।

এদিকে ভিসা-পলিসির উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা চিত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নাগরিকদের পাসপোর্ট ব্যবহারের দায়বদ্ধতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে ‘পাসপোর্ট পাওয়ার’ কেবল সংখ্যার হিসাব নয়, বরং এটি এক ধরনের আন্তর্জাতিক আস্থা ও সম্মানের মাপকাঠি।

বাংলাদেশ যেভাবে গত চার বছর ধরে ধারাবাহিক উন্নতির দিকে এগোচ্ছে, সেটি ধরে রাখতে হলে শুধু রাজনৈতিক প্রচেষ্টা নয়, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, অভিবাসন নীতি এবং আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপরও আরও জোর দিতে হবে।

অবশেষে বলা যায়, ২০২৫ সালের হেনলি পাসপোর্ট সূচকে ৯৪তম অবস্থান শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় যাত্রাপথের ছোট্ট ধাপ। এখান থেকে শুরু হোক বৃহত্তর ভ্রমণ স্বাধীনতা অর্জনের আরেকটি অধ্যায়।