ঢাকাশনিবার , ২ আগস্ট ২০২৫
  • অন্যান্য

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) কারা অর্থায়ন করে?

রঞ্জন কুমার দে
আগস্ট ২, ২০২৫ ৩:২৪ অপরাহ্ণ । ৩০২ জন

বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। যখনই কোনো নতুন রোগ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, অথবা যখন শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী সুদূর গ্রামে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয়, কিংবা যখন কোনো দেশে স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ সহায়তার প্রয়োজন হয়, তখন WHO-ই এগিয়ে আসে। এটি শুধুমাত্র রোগের প্রতিকার নয়, বরং রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, চিকিৎসা গবেষণা এবং সামগ্রিক জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই সুবিশাল বৈশ্বিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য যে বিপুল পরিমাণ তহবিলের প্রয়োজন হয়, তার উৎস কোথায়? ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের একটি বিশদ প্রতিবেদন এই প্রশ্নটির একটি স্পষ্ট এবং চিত্রভিত্তিক জবাব দিয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নের জটিল কাঠামোকে সহজভাবে তুলে ধরেছে।

এই সংস্থা মূলত দুই ধরনের তহবিল দ্বারা পরিচালিত হয়: নির্ধারিত অবদান (Assessed Contributions) এবং স্বেচ্ছামূলক অবদান (Voluntary Contributions)। এই দুটি উৎস মিলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্ষিক বাজেট গঠিত হয়, যার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হয়।

প্রথমেই আসা যাক নির্ধারিত অবদান (Assessed Contributions) প্রসঙ্গে। এই অর্থ হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রাপ্ত বাধ্যতামূলক অর্থ, যা জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে তাদের আর্থিক সামর্থ্য এবং জাতীয় আয়ের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই অবদানগুলির পরিমাণ স্থির করে, এবং এটি সদস্য দেশগুলির জন্য একটি আইনি বাধ্যবাধকতা। এর প্রধান সুবিধা হলো, এই তহবিল তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল এবং অনুমানযোগ্য, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তাদের মূল এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীগুলো চালানোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য আর্থিক ভিত্তি প্রদান করে। যেমন, সংক্রামক রোগের উপর নজরদারি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ, এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য নীতি সমন্বয় করার মতো কাজগুলো এই তহবিল থেকেই পরিচালিত হয়। তবে, মজার বিষয় হলো, ২০২২-২৩ সালের তথ্যানুসারে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মোট তহবিলের মাত্র প্রায় ১২% এসেছে এই নির্ধারিত অবদান থেকে। একসময় এটিই ছিল সংস্থার আয়ের প্রধান উৎস, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর অনুপাত কমতে শুরু করেছে। এর অর্থ হলো, সংস্থা তার বৃহৎ বৈশ্বিক দায়িত্ব পালনের জন্য শুধুমাত্র এই বাধ্যতামূলক অর্থের উপর নির্ভর করতে পারে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আয়ের সিংহভাগ, অর্থাৎ প্রায় ৮১%, আসে স্বেচ্ছামূলক অবদান (Voluntary Contributions) থেকে। এটিই হলো সংস্থার কার্যক্রমের মূল চালিকা শক্তি। এই স্বেচ্ছামূলক অর্থ আসে বিভিন্ন উৎস থেকে, যা সংস্থাকে তার বিস্তৃত কর্মসূচি এবং জরুরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়তা করে।

স্বেচ্ছামূলক অবদানের একটি বড় অংশ আসে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ থেকে, যারা তাদের নির্ধারিত অবদানের বাইরেও অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে। এই দেশগুলো বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাদের অঙ্গীকারের প্রমাণ হিসেবে নির্দিষ্ট কর্মসূচী বা উদ্যোগের জন্য স্বেচ্ছায় তহবিল প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছামূলক অবদানকারী দেশ। ২০২২-২৩ সালে তারা ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অনুদান দিয়েছে, যা মোট স্বেচ্ছামূলক তহবিলের ১৫.৬%। জার্মানি, ৭২২.৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় অবদানকারী। যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, নরওয়ে, জাপান, ভারত, ইরান, সৌদি আরব এবং নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্বেচ্ছামূলক অবদান রাখে। এই দেশগুলো প্রায়শই পোলিও নির্মূল, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, অথবা মহামারী প্রস্তুতির মতো নির্দিষ্ট বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় অর্থায়ন করে। তাদের এই অবদানগুলি কেবল আর্থিক সহায়তা নয়, বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য পূরণের প্রতি তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রতিফলন।

সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও, প্রতিষ্ঠা এবং ফাউন্ডেশন (Foundations and Philanthropic Organizations) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তহবিলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০২২-২৩ সালে তারা ৮২৬.৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে, যা মোট স্বেচ্ছামূলক তহবিলের ১২.৭% এবং এককভাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম অবদানকারী। এই ফাউন্ডেশন বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য ও উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করে এবং তাদের অর্থায়ন প্রায়শই সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য উদ্যোগ, যেমন ভ্যাকসিনেশন, ম্যালেরিয়া গবেষণা বা এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচীতে নিবদ্ধ থাকে। তাদের এই বড় মাপের বিনিয়োগ বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য কর্মসূচীগুলোতে বিশাল প্রভাব ফেলে।

এছাড়াও, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তহবিল পায়। এর মধ্যে রয়েছে GAVI অ্যালায়েন্স, যারা বিশ্বব্যাপী শিশুদের টিকাদান কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেয় এবং WHO-এর টিকাদান সংক্রান্ত কার্যক্রমে সহায়তা করে। ইউরোপীয় কমিশন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জনস্বাস্থ্য উদ্যোগগুলোতে সম্মিলিতভাবে অবদান রাখে। জাতিসংঘের সেন্ট্রাল ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড (UN CERF) জরুরি মানবিক সহায়তার জন্য তহবিল সরবরাহ করে, যার একটি অংশ WHO-এর জরুরী স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়াগুলিতে ব্যয় হয়। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল পোলিও নির্মূলের মতো সুনির্দিষ্ট বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রচারাভিযানে অর্থায়ন করে। ইউনিসেফ শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কিত কর্মসূচিতে অবদান রাখে। বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে সহায়তা করে। UN MPTF (Multi-Partner Trust Fund) হলো একটি তহবিল ব্যবস্থা যেখানে একাধিক দাতা একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তহবিল একত্রিত করে, যা WHO-কে তার বহুমুখী প্রকল্পগুলো চালাতে সাহায্য করে। এমনকি WHO-এর নিজস্ব কনটিনজেন্সি ফান্ডও (Contingency Fund) তার তহবিলের একটি অংশ, যা অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়।

এই স্বেচ্ছামূলক অবদানের উপর অত্যাধিক নির্ভরতার কিছু নিজস্ব চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেহেতু এই তহবিলগুলি প্রায়শই নির্দিষ্ট প্রকল্প বা উদ্দেশ্যের জন্য বরাদ্দ করা হয় (যাকে ‘earmarked’ ফান্ডিং বলে), তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার নিজস্ব কৌশলগত অগ্রাধিকারের চেয়ে দাতাদের পছন্দের ক্ষেত্রগুলোতে বেশি মনোযোগ দিতে বাধ্য হতে পারে। এটি সংস্থার নমনীয়তাকে সীমিত করে এবং এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যা দাতাদের কাছে ততটা আকর্ষণীয় নয়, সেখানে তহবিল সংগ্রহে অসুবিধা তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, স্বেচ্ছামূলক তহবিলগুলি নির্ধারিত অবদানের মতো স্থিতিশীল না হওয়ায়, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং বাজেট ব্যবস্থাপনায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

২০২২-২৩ সালের তথ্যানুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছামূলক অবদানকারী, তাদের ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অনুদান মোট স্বেচ্ছামূলক তহবিলের ১৫.৬% ছিল। সম্প্রতি, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২১ সালে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় সংস্থায় ফিরিয়ে আনেন। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল যে, সংস্থাটি “WHO সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনুপযুক্ত রাজনৈতিক প্রভাব থেকে স্বাধীনতা দেখাতে অক্ষম” এবং তারা “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যায়ভাবে কষ্টকর অর্থপ্রদানের” দাবি করে। এই ধরনের একটি বড় অবদানকারীর সম্ভাব্য প্রত্যাহার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাজেট এবং কার্যক্রমে একটি বিশাল শূন্যতা তৈরি করতে পারে, যা অন্যান্য দাতা দেশ বা সংস্থাগুলির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য।

চীনের অবদান প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। ২০২২-২৩ সালে চীনের স্বেচ্ছামূলক অবদানের পরিমাণ ছিল ৪১ মিলিয়ন ডলার, যা মোট স্বেচ্ছামূলক তহবিলের মাত্র ০.৬%। তবে, নির্ধারিত অবদানের ক্ষেত্রে, চীনকে ১১৫ মিলিয়ন ডলার দিতে হতো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ২১৯ মিলিয়ন ডলার নির্ধারিত ছিল। ট্রাম্পের যুক্তি ছিল যে চীনের জনসংখ্যা আমেরিকার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাদের নির্ধারিত অবদান তুলনামূলকভাবে কম। এই বিতর্কগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের প্রভাব নিয়ে চলমান আলোচনার অংশ।

সারসংক্ষেপে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি জটিল এবং বহু-সূত্রীয় অর্থায়ন মডেলের উপর নির্ভর করে, যেখানে নির্ধারিত এবং স্বেচ্ছামূলক উভয় ধরনের অবদানই এর কার্যক্রমকে সমর্থন করে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বাধ্যতামূলক অবদান একটি স্থিতিশীল ভিত্তি প্রদান করলেও, এর সিংহভাগ তহবিল আসে বিভিন্ন দেশ, বেসরকারি ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বেচ্ছামূলক অনুদান থেকে। এই বহুমুখী তহবিল ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরন্তর প্রচেষ্টাকে সম্ভব করে তোলে। তবে, দাতাদের পছন্দের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং বড় অবদানকারীদের সম্ভাব্য পরিবর্তন সংস্থার ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের জন্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করতে পারে। এই জটিল মডেলের মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে, যা আমাদের সবার সম্মিলিত সমর্থন ও বোঝাপড়ার উপর নির্ভর করে।