ঢাকামঙ্গলবার , ৯ ডিসেম্বর ২০২৫

দেশে নিকোটিন পাউচ কারখানা স্থাপনের অনুমোদন জনস্বাস্থ্য বিরোধী এবং বিপজ্জনক 

নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিসেম্বর ৯, ২০২৫ ১১:২৫ অপরাহ্ণ । ৮৫ জন
সৈয়দা অনন্যা রহমান, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মী

তামাকে যে সকল উপাদান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান উপাদন নিকোটিন। এটি উচ্চমাত্রার স্নায়ূবিষ। যা আসক্তি তৈরী করে। নিকোটিনের আসক্তিই তামাক ব্যবহারে আগ্র্রহী করে তোলে। নিকোটিন ধূমপান বা ভ্যাপিংয়ের মাধ্যমে খুব দ্রুত (মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে) রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর নিকোটিন ডোপামিন নামের কেমিক্যালের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যবহারকারী মুহূর্তের জন্য আরাম বা সুখানুভূতি অনুভব করেন। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক এটিকে “ভালো অনুভূতির উৎস” হিসেবে গ্রহণ করে এবং অভ্যস্থ ও নির্ভরশীল হয়ে পরে।

নিকোটিন না পেলে ভারসাম্য হারায়। ফলে আসক্তি থেকে ব্যবহারকারী বের হতে পারে না। উল্লেখ্য তামাকের কারণে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয় বছরে ৩০ হাজার ৫শত ৭০ কোটি টাকা।

নিকোটিন পাউচ কিশোর ও তরুণদের মধ্যে নিকোটিন আসক্তি বাড়িয়ে তোলে। সম্প্রতি তামাক কোম্পানি সিন্থেটিক বা আর্টিফিশিয়াল নিকোটিন ব্যবহার করে নতুন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ও নেশাজাতীয় পণ্য বাজারজাত করার চেষ্টা করছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

তামাক কোম্পানি এধরনের পণ্যকে তামাক ছাড়ার বিকল্প পন্থা হিসেবে প্রচার করলেও উচ্চ মাত্রার আসক্তির কারণে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নিকোটিন পাউচকে কখনোই তামাক ছাড়ার বিকল্প বা নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি হিসেবে অনুমোদন দেয়নি। ইতিমধ্যে ফ্রান্স, রাশিয়া, উজবেকিস্তানসহ বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশ নিকোটিন পাউচের উপাদন এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে।

বাংলাদেশ যখন ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্র) আইনটি সংশোধন করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে এবং অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যসহ ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিচ্ছে এমন সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল (PMI) নামে একটি বহুজাতিক তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানিকে নিকোটিন পাউচ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। যা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের পথে নতুন সংকট তৈরী করছে।

স্বাস্থ্য না স্বার্থ? কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যে আসক্তি সৃষ্টিকারী পণ্যর ব্যবহার বাংলাদেশে নেই,সেই পণ্যকে কম ক্ষতিকর উল্লেখ করে কারখানা স্থাপনের অনুমোদন প্রদান এবং দেশে ব্যবহারের সুযোগ তৈরী করে দেওয়া রাষ্ট্রের সংবিধান, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য ২০২১ সালে, একটি জনস্বার্থ বিষয়ক রীট (নম্বর ১৪২৭/২০২১) এর রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দেশে তামাক ব্যবহার হ্রাস এবং নতুন কোনো তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন না দেওয়ার নির্দেশনার পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান তামাক কোম্পানিগুলোকে বিকল্প, অ-তামাকজাত পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে বলেছেন।

দেশে আসক্তি সৃষ্টিকারী পণ্য নিকোটিন পাউচ এর কারখানা স্থাপনের অনুমোদন প্রকৃতপক্ষে কার বা কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? জনগনের তো নয় তাহলে? বেজা দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত একটি সরকারি সংস্থা সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাজ জনগনের কল্যানে কাজ করা। বেজার কাজ হওয়া উচিত রাষ্ট্রের উন্নয়নে কল্যাণমূলক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। সেকারণে তাদের দায়িত্ব কোনো বিনিয়োগ গ্রহনের পূর্বে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশ প্রভাব ও ঝুঁকি এবং আইনগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা।

জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরী করে এধরনের কোন পণ্য উৎপাদনের অনুমতি বেজা কেনভাবেই দিতে পারে না। মাত্র ৬৩ জনের কর্মসংস্থান ও ৫১ কোটি টাকার নগন্য বিনিয়োগের জন্য দেশের জনগনের স্বাস্থ্য বিবেচনা না করে এ ধরনের ক্ষতিকর নেশা সৃষ্টিকারী পণ্য উৎপাদন কারাখানা স্থাপনের অনুমোদন প্রদান অত্যন্ত দুঃখজনক।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে দেশে নিকোটিন পাউচসহ সব ধরনের নতুন নিকোটিন পণ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং বেজা কর্তৃক কারখানা স্থাপনের অনুমতি বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বাস্তবায়ন নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহনের পাশাপাশি দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি শক্তিশালী করা জরুরী।